ধ্যান ভ প্রার্থনা
শ্রী মায়ের বার্তা
1941 থেকে 1948 সময়কালে
মূল ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা একটি বইয়ের জন্য ইংরেজিতে লেখা ভূমিকা।
এখানে এই | বার্তা শুনুন |
কেউ আপনার আত্মাকে ধরে দেয় ভগবানের কাছে, কেউ দেয় তার জীবন, কেউ তার কর্ম, কেউ-বা তার অর্থ। অল্প কেউ নিজে যা তা সবখানি এবং যা আছে সবই আত্মা, জীবন, কর্ম, সম্পদ সব —
উৎসর্গ করে দেয়; এরাই হল ভগবানের সত্যকার সন্তান। অন্যরা কিছুই দেয় না এদের পদমর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ধন-দৌলত —
যাই হোক না, ভগবানের কাজে তার কোন মূল্য নেই, তা শূন্য ৷
এই গ্রন্থখানি তাদেরই জন্য যাদের আস্পৃহা ভগবানের কাছে নিঃশেষ উৎসর্গ।
– মিস্টার মা
১৯৪১ - ১৯৪৮
বছর: ১৯১২
২ নভেম্বর ১৯১২
এখানে এই | প্রার্থনা শুনুন |
হে পরম বিধাতা! সকল জিনিসের জীবন তুমি, জ্যোতি তুমি, প্রেম তুমি। আমার সমস্ত সত্তা ভাবে তোমার কাছে নিবেদিত বটে, কিন্তু কাজে ছোটখাট সব ব্যাপারে এ নিবেদনের প্রয়োগ আমার পক্ষে এখনও কষ্টকর। আমার এই লিখিত ধ্যানের হেতু ও সার্থকতা ঠিক এইখানে যে তা প্রতিদিন তোমারই উদ্দেশ্যে নিবেদিত। একথা বুঝতে আমার দরকার হয়েছে কয়েক সপ্তাহ। প্রতিদিনই তাহলে এই রকমে তোমার সঙ্গে আমার প্রায়ই যে আলাপ হয় তার কিছু একটু স্থূলরূপ দিয়ে ধরতে পারব। যথাসাধ্য আমি তোমার কাছে সব খুলে বলব – এ বিশ্বাসে নয় যে তোমাকে নূতন কিছু বলতে পারব – তুমিই তো সব জিনিস – কিন্তু এই জন্যে যে আমাদের বুঝবার দেখবার যে বহির্মুখী ও কৃত্রিম ধরন, তা তোমার কাছে অপরিচিত – আদৌ যদি একথা বলা চলে – তা তোমার প্রকৃতির বিপরীত। তা হলেও তোমার দিকে যখন ফিরে দাঁড়াব, এসব জিনিস দেখবার সময় তোমার আলোকে নিজেকে যখন অভিষিক্ত করব, তখন দেখতে পাব ক্রমে তারা তাদের সত্যকার স্বরূপের মত হয়ে উঠেছে। একদিন শেষে আসবে যেদিন তোমার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ এক হয়ে যাব, তখন আর তোমাকে কিছু বলবার আমার থাকবে না, কারণ আমি তো তুমিই হয়ে যাব। ঠিক এই লক্ষ্যেই তো পৌঁছতে চাই, ঠিক এই বিজয়ের দিকেই তো আমার সকল প্রয়াস আমি নিয়োগ করতে চাই। সেদিনের অপেক্ষায় আমি রয়েছি যেদিন আমি আর “আমি” বলতে পারব না, কারণ আমি হয়ে যাবে তুমি।
প্রতিদিনই এখনও কতবার না এমন হয়েছে যে আমার কাজ তোমার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়নি। তখনি সে-কথা আমি বুঝতে পারি কেমন একটা অস্বস্তির জন্যে, শরীরের মধ্যে তা আমি অনুভব করি - তার প্রকাশ হল বুকে একটা চাপ। কাজটি তখন নিজের থেকে আলাদা করে সামনে ধরি, দেখতে পাই হয় সেটি হাস্যকর, নয় বালোচিত, আর না-হয় সত্যই দোষের; সেজন্যে দুঃখ হয়, এক মুহূর্তের জন্যে বিষণ্ন হয়ে পড়ি। কিন্তু তার পরেই তোমার মধ্যে ডুবে যাই, হারিয়ে যাই, শিশুর নির্ভর নিয়ে, অপেক্ষা করি তোমার কাছ থেকে অনুপ্রেরণার জন্যে, সামর্থ্যের জন্যে যাতে আমার ভিতরকার, আমার চারিদিকের ভুল শুধরে ওঠে – এ দুটি তো একই; কারণ, এখন আমি নিরন্তর সুস্পষ্ট দেখতে পাই বিশ্বব্যাপী ঐক্যই সকল ক্রিয়াবলীর মধ্যে পরস্পরের একান্ত নির্ভরতা বিহিত করে দিয়েছে।
১৯ নভেম্বর ১৯১২
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
এই যে ইংরেজ ছেলেটি এতখানি আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তোমার অনুসন্ধানে চলেছে, তাকে কাল আমি বলেছি – তোমাকে আমি চিরতরে পেয়েছি, তোমার আমার সংযোগ নিরন্তর; বাস্তবিকই এই হল আমার অবস্থা, যতদূর সে-সম্বন্ধে আমি সচেতন। আমার সকল চিন্তা চলেছে তোমার দিকে, আমার সকল কর্ম তোমার কাছে উৎসর্গীকৃত। তোমার সান্নিধ্য আমার কাছে ধ্রুব, অটুট, অচঞ্চল, বাস্তব; তোমার শান্তি আমার হৃদয়ে নিরন্তর বিরাজমান। তবুও আমি জানি এই যে মিলনের অবস্থা এও অকিঞ্চিৎকর অনিশ্চিত, কাল যে অবস্থা আমার অধিগত হবে তার তুলনায়। আমি জানি সে-একাত্মতা থেকে আমি এখনও দূরে – নিশ্চয়ই বহু দূরে – যেখানে আমার আমি-জ্ঞান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যাবে, এই যে “আমি” কথাটি এখনও নিজেকে প্রকাশ করবার সময়ে আমি ব্যবহার করি; কিন্তু ব্যবহার করলেও প্রত্যেকবারেই তাকে কেমন বাধা বলে মনে হয়, যেন যে-চিন্তাটি নিজেকে প্রকাশ করতে চায়, তাকে প্ৰকাশ করবার উপযুক্ত কথাটি ও নয় – মানুষী আদান-প্রদানের পক্ষে প্রয়োজন হিসাবে তা অপরিহার্য হতে পারে; তবে সব নির্ভর করে এই “আমি” কি ব্যক্ত করে তার উপর। এরই মধ্যে কতবার এমন হয়েছে যে যখন কথাটি উচ্চারণ করেছি, তখন তুমিই আমার মধ্যে কথা বলেছ, কারণ সকল পার্থক্যবোধ আমার লুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু এখনও এ সমস্ত জিনিস ভ্রূণ-অবস্থায়, এখনও তাদের ক্রমপুষ্টি চলতে থাকবে। তোমার সর্বশক্তিমত্তার উপর প্রশান্ত নির্ভর কি নিশ্চিন্ত নিশ্চয়তাই না এনে দেয়!
সব তুমি, সর্বত্র তুমি, সবের মধ্যে তুমি। এই যে দেহ কাজ করছে, সমগ্র দৃশ্যমান বিশ্বের মতই তা ঠিক তোমার নিজের দেহ। তুমিই শ্বাস ফেলছ, চিন্তা করছ, ভালবাসছ এই সত্তাটির মধ্যে সে-সত্তা তুমিই, তাই সে হতে চায় তোমার অনুগত দাসী।
২৬ নভেম্বর ১৯১২
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
প্রতিমুহূর্তে আমার অন্তরতম কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তোমার কোন্ স্তুতিগানই না আমি করব! আমার চারিদিকে, সর্বত্র সব জিনিসের মধ্যে তুমি তোমাকে প্রকাশ করে চলেছ! আমারও মধ্যে তোমার চেতনা, তোমার – ইচ্ছা ক্রমেই স্পষ্টতর ফুটে উঠছে এতখানি তা অগ্রসর হয়েছে যে “আমি” “আমার” বলে এই অতিস্থূল মায়াভ্রান্তি প্রায় সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে। ঐ যে বৃহৎ-জ্যোতি তোমাকে প্রকাশ করে ধরেছে, তার মধ্যে যদি এখনও একটু ছায়া, একটু কালোরেখা কোথাও দেখা যায়, তবে তারা কতদিন আর তোমার ঐ ভাস্বর প্রেমের অপরূপ দীপ্তি সহ্য করে থাকবে? যে সত্তাটির নাম ছিল “আমি” তাকে নিয়ে তুমি যা গড়ে তুলেছ আজ সকালে আমার চেতনায় তার তুলনা এল কারুশ্রীময় একখানি হীরকখণ্ডের সঙ্গে, তার প্রতিটি দিক কেটে কেটে সুষীম সুরেখ জ্যামিতিক আকার দেওয়া হয়েছে, – আর তার আছে হীরকেরই ঘনতা, দৃঢ়তা, বর্ণহীন অমলতা, স্বচ্ছতা; সেই সঙ্গে সে আবার যেন একখানি দীপ্ত প্রোজ্জ্বল শিখা – এমন প্রখর ঊর্ধ্বগামী জীবনীশক্তি তার। কিন্তু এসবের চেয়ে তা আরো বেশি কিছু, আরো উৎকৃষ্ট কিছু; কারণ সে- বস্তুটি বাহ্য বা আন্তর সকল রকম অনুভব ছাড়িয়ে। পূর্বোক্ত ছবিখানি আমার মনের মধ্যে এসে দেখা দিল কেবল তখনি যখন ক্রমে বাহ্যজগতের চেতনা আবার আমার ফিরে আসতে শুরু করেছে।
হে ভগবান! অভিজ্ঞতাকে তুমিই ফলপ্রসূ করে ধর। তোমারই কল্যাণে জীবন ক্রমোন্নতি লাভ করে, অন্ধকার বাধ্য হয় আলোর স্পর্শে অবিলম্বে মিলিয়ে যেতে, প্রেমকে তুমি দাও তার সব শক্তি, আর জড়কে পর্যন্ত সর্বত্র ঊর্ধ্বে তুলে ধর, তার মধ্যে এই অপরূপ প্রজ্বলন্ত আস্পৃহা ভরে দিয়ে, আনন্ত্যের এই মহৎ তৃষ্ণায় ভরে দিয়ে।
তুমি সর্বত্র সর্বদা – কেবলমাত্র তুমিই, রূপে ও স্বরূপে...
ছায়া, মায়া, মিলিয়ে যাও! দুঃখকষ্ট, লুপ্ত হও! ভগবান সর্বেশ্বর, ঐ তুমি রয়েছ না?
২৮ নভেম্বর ১৯১২
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
ধ্যানে ধারণায় যে সময় অতিবাহিত হয় তার অপরিহার্য প্রতিপূরক নয় কি বাহ্য-জীবন, প্রতিদিনের প্রতিমুহূর্তের কর্ম? এই দুটিতে যতখানি করে সময় দেওয়া হয় সেই অনুপাতই নির্দেশ করে মানুষকে কতখানি চেষ্টা করতে হবে তৈরী হবার জন্যে আর কতখানিই বা বাস্তব সিদ্ধির জন্যে এ-দুয়ের যথাযথ অনুপাত। কারণ ধ্যান-ধারণা ভগবৎ-মিলন, এ হল লব্ধ ফল, পূর্ণ প্রস্ফুটিত ফুল। আর দৈনন্দিন কর্ম হল যেন কামারের হাতুড়ি যার আঘাত পড়বে প্রতি অঙ্গের উপর যাতে তারা হয় সুনম্য, শুদ্ধ, সংস্কৃত – যাতে ধ্যান তাদের এনে দেবে যে জ্যোতিঃপ্রকাশ তা ধারণের জন্যে হয় তারা পরিপক্ক। এ-রকমে একের পর এক প্রত্যেক অঙ্গকে অগ্নিপরীক্ষার ভিতর দিয়ে নিয়ে যেতে হবে যতদিন সর্বাঙ্গীণ উৎকর্ষের জন্যে বাহ্যক্রিয়ার প্রয়োজন আর না হয়। বাহ্যক্রিয়া তখন হয়ে উঠবে তোমার প্রকাশের যন্ত্র, যাতে অন্যান্য চেতনার কেন্দ্র সব জাগ্রত হয় সেই একই যুগ্ম ক্রিয়ার জন্যে – একদিকে অগ্নিশুদ্ধি আর একদিকে জ্যোতিঃসিদ্ধি (দাহন এবং দীপন)। এই জন্যেই আত্মশ্লাঘা আর আত্মতর্পণের মত বাধা আর কিছু নেই। এই যেসব অসংখ্য সত্তা রয়েছে, তাদের কয়েকটি অন্তত যাতে ঢালাই করা হয়, শুদ্ধ করা হয়, যাতে তারা নমনীয় হয়, নৈর্ব্যক্তিক হয়, যাতে তারা শিখতে পারে আত্মবিস্মৃতি, আত্মত্যাগ, নিষ্ঠা, মৈত্রী, নম্রতা – এজন্যে এমন সুযোগ যদি কিছু আসে – যৎসামান্য হলেও, তৎক্ষণাৎ তাকে গ্রহণ করতে হয় অত্যন্ত বিনম্রতার সঙ্গে, যতটুকু লাভ তা থেকে আসতে পারে তাই আদায় করে নিতে হয়। জীবনের এ-ধরনের যাবতীয় বৃত্তি যখন সে-সব সত্তাদের পক্ষে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে তখনই তারা ধ্যান-ধারণার অধিকার পায়, তৈরী হয় পরম তাদাত্ম্যের মধ্যে তোমার সঙ্গে একীভূত হয়ে যেতে। এই জন্যেই আমি মনে করি শ্রেষ্ঠ সাধকের পক্ষেও কর্মসাধনা দীর্ঘ ও মন্থর হতে বাধ্য। হঠাৎ-সিদ্ধিসব কখনও সর্বাঙ্গীণ হতে পারে না – তাতে ঘটে সত্তার দিক্-পরিবর্তন, সত্য-ব্রতের পথে নিশ্চিতভাবেই উঠে সে দাঁড়ায়। কিন্তু এ লক্ষ্যে সত্যসত্যই পৌঁছতে হলে, প্রতিমুহূর্তের সকলরকম বহুতর অভিজ্ঞতা না স্বীকার করে উপায় নেই কারো পক্ষেই |
...হে পরম অধীশ্বর! আমার মধ্যে, প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে তুমি প্রোজ্জ্বল তোমার জ্যোতির আবির্ভাব হোক, তোমার শান্তির রাজত্ব আরম্ভ হোক, সকলের জন্যে ।
২ ডিসেম্বর ১৯১২
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
যতক্ষণ অবধি সত্তার একটি উপকরণও, চিন্তার একটি ধারাও পরধর্মী প্রভাবের অনুগত থাকে, অর্থাৎ কেবলমাত্র তোমারই প্রভাবের মধ্যে না থাকে, ততক্ষণ বলা চলে না যথার্থ মিলন সংঘটিত হয়েছে – ততক্ষণও রয়েছে সে দারুণ ব্যামিশ্রতা যাতে নেই শৃঙ্খলা, নেই আলো। কারণ সে-উপকরণটি, সে-ধারাটি যেন একখানি জগৎ, বিশৃঙ্খলার নিরালোকের জগৎ – জড়ের জগতে সমস্ত পৃথিবী যে-রকম, আবার সমস্ত বিশ্বের মধ্যে জড়-জগৎ যে-রকম…
৩ ডিসেম্বর ১৯১২
এখানে এই | প্রার্থনা শুনুন |
কাল রাত্রে আমি পরীক্ষা করলাম তুমি যেমন চালাও তেমনি নির্ভর করে নিজেকে ছেড়ে দিলে কি সুফল তার হয়। যে-জিনিস যখন জানা প্রয়োজন তা ঠিকই জানা যায়; তোমার জ্যোতির দিকে ফিরে মন যত নিশ্চল থাকে, সত্যের প্রকাশও তার মধ্যে হয় তত সুষ্ঠু ও সুস্পষ্ট।
আমার ভিতরে তুমি কথা বলছ শুনতে পেলাম – ইচ্ছা হয়েছিল যা বলছ লেখায় যদি ধরে রাখা যেত, যাতে যথাযথ বাক্য তোমার এতটুকু নষ্ট না হয়; কারণ তুমি যা বলেছ এখন তা পুনরুক্তি করা আমার পক্ষে অসম্ভব। পরে ভেবে দেখলাম এই যে ধরে রাখার স্পৃহা, এও তোমার উপর নির্ভরের অভাব, এতে তোমাকে অপমানই করা হয়। কারণ আমাকে যা হতে হবে, আমাকে দিয়ে তাই করে নিতে পার তুমি; যে পরিমাণে আমার মতিগতি তোমাকে আমার উপর এবং আমার মধ্যে কাজ করতে পথ ছেড়ে দেয়, সেই পরিমাণেই তুমি অবাধে সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠ। এ জ্ঞান থাকা দরকার যে প্রতি মুহূর্তে যা হওয়া উচিত তাই হয়, যতটা সম্ভব সুষ্ঠুভাবে নিশ্চিতভাবে – অবশ্য তাদের পক্ষে, যারা সকল জিনিসের মধ্যে সর্বত্র তোমাকেই দেখতে পায়। তখন আর শঙ্কা নেই, উদ্বেগ নেই, ক্ষোভ নেই – আছে কেবল পরম প্রসন্নতা, চরম নির্ভর আর একান্ত নিৰ্বিচল শান্তি…
৫ ডিসেম্বর ১৯১২
এখানে এই | প্রার্থনা শুনুন |
শান্তি ও নীরবতারই মধ্যে অনন্ত ভগবান প্রকট হয়ে থাকেন। কোন কিছুতেই নিজেকে বিক্ষুব্ধ হতে দিও না, তবে অনন্ত ভগবান প্রকট হবেন। সর্বাবস্থায় থাকবে সম্পূর্ণ সমচিত্ত, তবে অনন্ত এসে উপস্থিত হবেন।... সত্যই তো, তোমার অন্বেষণেও অতিরিক্ত উগ্রতা বা কষ্টপ্রয়াস রাখা উচিত নয়। এ উগ্রতা এ প্রয়াস তোমার সম্মুখে আবরণ টেনে দেয় ৷ তোমাকে দেখবার জন্যেও কামনা করা উচিত নয়, কারণ তা হল মানস- চাঞ্চল্য, তোমার নিত্য সান্নিধ্য তাতে আবৃত হয় মাত্র। শান্তি যেখানে, প্রসন্নতা যেখানে, পূর্ণতম সমতা যেখানে, সেইখানেই তুমি সব আর সবই তুমি। এই যে সর্বতোভাবে বিশুদ্ধ ও প্রশান্ত পরিবেশ তার মধ্যে অতি ক্ষুদ্রতম তরঙ্গও তোমার প্রকাশের অন্তরায় হয়ে ওঠে। ত্বরা নয়, চিন্তা নয়, কৃচ্ছ্রতা নয় – এক তুমিই, তুমি ছাড়া আর কিছুই নয়; তবে বিশ্লেষণ করে, জ্ঞানের বিষয় করে তোমাকে পাওয়া নয় – তুমি রয়েছ, বিন্দুমাত্র সন্দেহ তাতে নেই, কারণ, সব সেখানে হয়ে উঠেছে বিশুদ্ধ শান্তি, দিব্য নীরবতা ৷
আর বিশ্বের যাবতীয় ধ্যানের চেয়ে তাই শ্রেয় ৷
৭ ডিসেম্বর ১৯১২
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
শিখা যেমন জ্বলে নির্বাক হয়ে, সুবাস যেমন অবিকম্পে সোজা ঊর্ধ্বে উঠে যায়, আমার ভালবাসাও তেমনি চলে তোমার দিকে। শিশু যেমন তর্ক করে না, কিছুরই জন্য চিন্তাও করে না, আমিও তেমনি তোমাতে নির্ভর করি, তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক, তোমার আলো ফুটে উঠুক, তোমার শান্তি ছড়িয়ে পড়ুক, তোমার ভালবাসা জগৎ ছেয়ে দিক। তোমার ইচ্ছা যখন হবে, তোমার মধ্যে আমি থাকব একই অভিন্ন হয়ে
– সেই শুভক্ষণের অপেক্ষায় আমি রয়েছি, কিন্তু কোন রকমে অধীর না হয়ে; নিজেকে ছেড়ে দিয়েছি অব্যর্থভাবে তারই দিকে বয়ে যেতে, প্ৰশান্ত নদী যেমন বয়ে যায় অপার সাগরের দিকে।
তোমার শান্তি আমার অন্তরে, এই শান্তির মধ্যে আমি দেখি কেবল রয়েছ তুমি, শাশ্বতের নিশ্চলতা নিয়ে।
১০ ডিসেম্বর ১৯১২
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
হে পরম বিধাতা! শাশ্বত দিশারী! আবার তুমি আমায় নিঃসংশয়ে বুঝিয়ে দিলে তোমার নির্দেশের উপর পূর্ণ নির্ভরতা এনে দেয় কি অনুপম সফলতা। গতকাল আমার বাণীর মধ্য দিয়ে তোমার আলো অবাধে প্রকাশ হয়েছে; যন্ত্র হয়েছে সুনম্য, অনুগত, শাণিত।
সকল জীবে, সকল বস্তুতে তুমিই তো কর্ম করে চলেছ; আর যে তোমার এত সান্নিধ্যে এসেছে যাবতীয় কর্মে কেবল তোমাকেই দেখতে পায়, সে-ই তো পারে সকল কর্মকে তোমার আশীর্বাদে রূপান্তরিত করতে।
একমাত্র প্রয়োজন তোমার মধ্যে সর্বদা বাস করা, তোমারই মধ্যে – মিথ্যা-মায়া ইন্দ্রিয়ের সর্বদা, নিরন্তর গভীর হতে গভীরতরভাবে ছলনা ছাড়িয়ে অথচ কর্মে বীতরাগ না হয়ে, তাকে অস্বীকার বা পরিত্যাগ না করে – কারণ সে-রকম সংগ্রাম নিষ্ফল, অশ্রেয়ঙ্কর, কিন্তু যে-কৰ্মই হোক না কেন তারই ভিতর দিয়ে তোমারই মধ্যে বাস করা, চিরকাল, চিরকাল। তখনই সকল ভ্রান্তি হয় দূর, ইন্দ্রিয়ের মিথ্যা ছলনার হয় অবসান, কর্মবন্ধনের হয় স্খলন, তোমারই শাশ্বত সান্নিধ্যের মহিমায় বকিছু হয় রূপান্তরিত।
তাই হোক তবে।
১১ ডিসেম্বর ১৯১২
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
....ধীর স্থির হয়ে আমি অপেক্ষা করছি যাতে আর একটা আবরণ ছিন্ন হয়ে যায়, তোমার সঙ্গে মিলন হয় আরও সুসম্পূর্ণ। আমি জানি এই আবরণ গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ত্রুটির, অসংখ্য বন্ধনের সমষ্টি নিয়ে... কি করে হবে এ-গ্রন্থির অপসরণ? ধীরে ধীরে, অগণিত ক্ষুদ্র প্রয়াস ও অনিমেষ অতন্দ্র পর্যবেক্ষণার সাহায্যে, না অকস্মাৎ তোমার সর্বশক্তিমান প্রেমের এক বিপুল উদ্ভাসনে? জানি না – আমি আমায় এ প্রশ্ন কখনও করি না; অপেক্ষা করছি, যথাসাধ্য সতর্ক দৃষ্টি রেখে, কিন্তু নিশ্চয় জেনে যে একমাত্র তোমার ইচ্ছাই জেগে রয়েছে, একমাত্র তুমিই কর্ম করে চলেছ; আমি তো যন্ত্র মাত্র। যন্ত্রটি যখন পূর্ণতর প্রকাশের জন্যে প্রস্তুত হবে, তখন স্বতঃই সে-প্রকাশ ঘটবে।
আবরণের আড়াল থেকে এখনই ঐ না শোনা যায় আনন্দের মৌন সঙ্গীত – তোমারই মহান্ আবির্ভাব প্রকট করে।
বছর: ১৯১৩
৫ ফেব্রুয়ারী ১৯১৩
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
মধুর একখানি গানের মত তোমার কণ্ঠ শুনি আমি আমার হৃদয়ের নীরব গহনে – আমার মস্তিষ্কের মধ্যে তা রূপ নেয় অসম্পূর্ণ কথা দিয়ে। যদিও, সে-সব কথায় তুমিই রয়েছ সর্বতোভাবে ওতপ্রোত। সে-কথা পৃথিবীর উদ্দেশ্যে। তারা পৃথিবীকে বলছে – “ওগো দুঃখিনী পৃথিবী, মনে রেখো তোমার অন্তরে আমিই রয়েছি, নিরাশ হয়ো না । তোমার প্রতিটি চেষ্টা, প্রত্যেক ব্যথা, প্রত্যেক উল্লাস আর প্রত্যেক বেদনা, তোমার হৃদয়ের প্রত্যেক আহ্বান, তোমার মর্মের প্রত্যেক আকাঙ্ক্ষা, তোমার ঋতুচক্রের প্রত্যেক পুনরাবর্তন, সব জিনিস, কোন কিছু বাদ না দিয়ে – তোমার কাছে যা দুঃখের মনে হয় আর যা সুখের মনে হয়, যা মনে হয় কুৎসিত, আর যা মনে হয় সুন্দর, সকলে – সকলে অনিবার্যভাবে তোমাকে নিয়ে চলেছে আমারই দিকে – আমি অন্তহীন শান্তি, ছায়াহীন আলো, ছেদহীন সম্মিলন, একান্ত নিঃসংশয়তা, বিশ্রান্তি, – পরম আশীর্বাদ।
শোন, পৃথিবী, ঐ ফুটে ওঠে অপরূপ কণ্ঠ।
শোন, আবার সাহসে ভর কর।”
৮ ফেব্রুয়ারী ১৯১৩
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
ভগবান, তুমি আমার আশ্রয়, আমার আশিস, আমার শক্তি, আমার স্বাস্থ্য, আমার আশা, আমার সাহস। তুমিই পরমা শান্তি, অমিশ্র আনন্দ, অম্লান প্রসন্নতা। আমার সমস্ত আধার তোমার সম্মুখে সাষ্টাঙ্গে প্রণত, অসীম কৃতজ্ঞতা, অবিচ্ছিন্ন আরাধনা নিয়ে। এই আরাধনা তোমার দিকে উঠে চলেছে আমার হৃদয় হতে, আমার মন হতে, ভারতবর্ষের সুগন্ধি বিশুদ্ধ ধূপশিখার মত।
মানুষের কাছে আমি যেন তোমার আগমনী ঘোষণা করতে পারি, যাতে প্রস্তুত যারা তারাই সকলে, তুমি তোমার অসীম করুণায় যে- আনন্দ আমায় বিতরণ করেছ সে-আনন্দ উপভোগ করতে পারে, যাতে তোমার শান্তি পৃথিবীর উপর বিরাজ করে।
১০ ফেব্রুয়ারী ১৯১৩
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
আমার সত্তা তোমার দিকে উঠে চলেছে স্তুতিমুখর হয়ে, এ জন্যে নয় যে তুমি এই দুর্বল অসম্পূর্ণ আধারটি আশ্রয় করে আত্মপ্রকাশ করেছ; তুমি যে আদৌ নিজেকে প্রকাশ করেছ এই জন্যে, আর তা হল সকল জ্যোতির জ্যোতি, সকল আনন্দের আনন্দ, সকল আশ্চর্যের আশ্চর্য। যারাই তোমাকে সাগ্রহে খোঁজে তাদেরই জানা উচিত যে যখনি যেখানে প্রয়োজন তখনি তথায় তুমি উপস্থিত। তারা যদি এই স্থির বিশ্বাস ধরে থাকতে পারে, তোমাকে খোঁজাখুঁজি না করে, তোমার সেবায় প্রতি মুহূর্তে অখণ্ডভাবে নিজেকে নিয়োগ করে শুধু অপেক্ষায় থাকে, তাহলে যখনই প্রয়োজন হবে তখনি তুমি এসে উপস্থিত হবে – আর ফলতঃ প্রয়োজন সব সময়েই নয় কি যে তুমি উপস্থিত থাক, যে রূপ ধরেই
তোমার সে আবির্ভাব হোক না – অনেক সময়ে তা অপ্রত্যাশিত রকমে হলেও-বা।
তোমার মহিমা ঘোষিত হোক,
জীবন তাতে বিশুদ্ধ হয়ে উঠুক,
হৃদয় সব তাতে রূপান্তরিত হোক,
পৃথিবীতে বিরাজ করুক তোমার শান্তি।
১২ ফেব্রুয়ারী ১৯১৩
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
একটা সৃষ্টির মধ্যে কোন চেষ্টাই যখন আর থাকে না, তখনি তা হয়ে ওঠে অতি সরল, ফুল যেমন ফোটে তেমনি সরল – যখন সে তার সৌন্দর্য প্রকাশ করে চলে, তার সৌরভ ছড়িয়ে দেয় বাক্-আড়ম্বর না করে, রূঢ় অঙ্গ-সঞ্চালন না করে। আর ঠিক সেই সারল্যেরই মধ্যে রয়েছে সবচেয়ে বড় শক্তি, যার সঙ্গে মিশে থাকে সবচেয়ে কম খাদ, যার পরিণামে ঘটে সবচেয়ে কম কুফল। প্রাণশক্তি সম্বন্ধে সাবধান থাকবে - কর্মসাধনার পথে এ হল প্রলোভক, তার ফাঁদে পড়বার বিপদ সর্বদাই রয়েছে; কারণ সে তোমার প্রীতি সম্পাদন করে আশু ফল দেখিয়ে। আর কাজটি ভাল করে করবার প্রথম উৎসাহে এ শক্তির সাহায্য আমরা গ্রহণ করে বসি – কিন্তু পরেই দেখি কর্মকে সে বিকর্মে নিয়ে চলেছে, যা-কিছু করা যায় তার মধ্যে এনে ফেলেছে বিভ্রান্তির ও মৃত্যুর বীজ।
সরলতা! সরলতা! তুমি যেখানে কি মধুর নির্মলতা সেখানে...
১১ মে ১৯১৩
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
মে ১১, ১৯১৩
স্থূল-বৈষয়িক দায়িত্ব যখন আমার আর কিছু থাকে না, তখন সে-সব জিনিসের ভাবনা-চিন্তা দূরে চলে যায়, আমার মন ব্যাপৃত থাকে একান্তভাবে সম্পূর্ণভাবে তোমাকে নিয়ে, তোমার সেবা নিয়ে। পরিপূর্ণ শান্তি ও প্রসন্নতার মধ্যে আমার ইচ্ছাকে তোমার ইচ্ছার সঙ্গে এক করে ধরি, অখণ্ড নীরবতার মধ্যে শুনি তোমার সত্যের স্ফুরণ।
তোমার ইচ্ছার জ্ঞান যখন আমাদের হয়, আমাদের ইচ্ছাকে যখন তোমার ইচ্ছার সঙ্গে মিলিয়ে দিই, তখনি লাভ করি সত্যকার স্বাতন্ত্র্য ও সর্বশক্তিমত্তার রহস্য, সামর্থ্যের পুনরুজ্জীবন-রহস্য, সত্তার রূপান্তররহস্য।
তোমার সঙ্গে অখণ্ড ও নিরবচ্ছিন্ন সম্মিলন রাখা অর্থ নিঃসংশয়ে সকল বাধা অতিক্রম করা, বাহিরের ও ভিতরের সকল বিঘ্ন জয় করা।
ভগবান, ভগবান! সীমাহীন আনন্দ পূর্ণ করেছে আমার হৃদয়, আমার মস্তিষ্ক ভরে দিয়ে উল্লাসের উদ্গীথ চলেছে তার অপরূপ ঢেউ সব তুলে দিয়ে; তোমার বিজয় স্থির-নিশ্চিত, এই দৃঢ়প্রত্যয়ের মধ্যে আমি পেয়েছি পরমা শান্তির অজেয় শক্তি। তুমি আমার সত্তা ভরে রয়েছ, তাকে সঞ্জীবিত রেখেছ, তার প্রচ্ছন্ন উৎস সব সঞ্চালিত করেছ, তার বুদ্ধিকে আলোকিত করেছ, তার প্রাণকে প্রখর করেছ, প্রেমকে বহুগুণিত করেছ। এখন আমি তাই বলতে পারি না, আমিই বিশ্ব না বিশ্বই আমি, তুমি আমার মধ্যে না আমি তোমার মধ্যে। একমাত্র তুমিই রয়েছ, সবই তুমি, তোমার অসীম করুণার উচ্ছ্বসিত ধারা জগৎকে পরিপূর্ণ করেছে, ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
পৃথিবী! গাও স্তুতি!
গাও স্তুতি, জাতি সব, মানুষ সব!
দিব্য সমন্বয় এসেছে।
১৮ জুন ১৯১৩
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
নীরবতার মধ্যে, একান্তের মধ্যে পূর্ণ ধ্যান-সিদ্ধি হয়েছে যার, তারও সে-অবস্থালাভ হয়েছে নিজের দেহ থেকে নিজেকে পৃথক করে নিয়ে দেহটাকে বিযুক্ত করে দিয়ে; ফলে হয়, শরীর যে উপাদানে গঠিত তা ঠিক পূর্ববৎ অশুদ্ধ ও অপূর্ণই রয়ে যায়, কারণ তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় নিজেকে নিয়ে নিজে পড়ে থাকতে। একটা ভ্রান্ত অধ্যাত্মস্পৃহা, স্থূলাতীত ঐশ্বর্যের প্রতি আকর্ষণ, ব্যক্তিগত তৃপ্তির জন্যে তোমার সঙ্গে সম্মিলনের অহম্মন্য আকাঙ্ক্ষা, এ সকল কারণে মানুষ পার্থিব জীবনের সার্থকতা হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়, জড়ের শুদ্ধি ও নবরূপায়ণের যে ব্রত তা থেকে কাপুরুষের মত সরে দাড়ায়। আমাদের সত্তার একটি অংশ সর্বতোভাবে শুদ্ধ এই জ্ঞান আর সেই অংশটির সঙ্গে সংযোগ ও একাত্মতা আমাদের উপকারে আসতে পারে তখনই যখন সে জ্ঞান প্রয়োগ করা হয় পার্থিব রূপান্তর দ্রুততর করবার জন্যে, তোমার সুমহান কর্ম সংসিদ্ধির জন্যে।
২১ জুলাই ১৯১৩
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
...সত্যই তো, কতখানি না ধৈর্যের প্রয়োজন! উন্নতি তো লক্ষ্যই হয় না…
আমি তোমায় কত না আহ্বান করি, আমার হৃদয়ের অন্তস্তল হতে – হে ভগবান, হে অধীশ্বর, হে সত্যতম জ্যোতি, হে মহত্তম প্ৰেম । তুমি আমাদের দিয়েছ জীবনীশক্তি, দিয়েছ আলো, দিশারী তুমি, রক্ষক তুমি, আমাদের প্রাণের প্রাণ তুমি, জীবনের জীবন, আমাদের সত্তার মূল হেতু তুমি, তুমি পরমতম জ্ঞান, অব্যয় শান্তি।
২৮ নভেম্বর ১৯১৩
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
ভোরের মুখে এই যে প্রশান্ত সমাহিতি, অন্যান্য মুহূর্তের চেয়ে এই এখনই বেশি সুন্দরভাবে তোমার দিকে উঠে চলে আমার চিন্তা, গাঢ় প্রার্থনা নিয়ে, হে আমার আধারের অধীশ্বর!
এই যে দিনটি শুরু হতে চলল, পৃথিবীর কাছে, মানুষের কাছে সে যেন নিয়ে আসে আরো একটু নির্মলতার আলো, আরো একটু সত্যকার শান্তি, তোমার প্রকাশ হয় যেন আরো পূর্ণতর, তোমার মধুর বিধান হয় যেন আরো বেশি স্বীকৃত; একটা ঊর্ধ্বতর মহত্তর সত্যতর কিছু যেন মানবজাতির কাছে উদ্ঘাটিত হয়; একটা বৃহত্তর গভীরতর প্রেম যেন ছড়িয়ে পড়ে আর তাতে ক্ষতের চিহ্ন সব যেন শুকিয়ে মিলিয়ে যায়। এই যে সূর্যের প্রথম কিরণ ফুটে উঠছে, তা যেন আনন্দের সম্মিলনের ঘোষণা করে, জীবনের মর্মমূলে লুকিয়ে যে প্রোজ্জ্বল মহিমা, হয় যেন তারই প্রতীক।
ভগবান! বিশ্বপ্রভু! আজকার দিনই যেন হয় শুভযোগ যখন তোমার বিধানের সম্পূর্ণ অনুগত আমরা হয়ে উঠতে পারি, তোমার কর্মে অখণ্ডভাবে যেন নিজেকে উৎসর্গ করে দিতে পারি, নিজেকে ভুলে যেতে পারি একান্তভাবে, লাভ করতে পারি বৃহত্তর আলো, শুদ্ধতর প্রেম। তোমার তোমার সঙ্গে নিত্যই যেন আরো গভীরভাবে, কাছে এই প্রার্থনা আরো নিরবচ্ছিন্নভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারি, ক্রমে যেন তোমাতে আরো একীভূত হয়ে যেতে পারি, হয়ে উঠতে পারি তোমার সুযোগ্য সেবক। দূর করে দাও আমাদের অহমিকা, সকল তুচ্ছ গর্ব, সকল লোভ, সকল মোহ; তোমার দিব্যপ্রেমের আগুনে যেন সম্পূর্ণ জ্বলে উঠতে পারি, জগতে হয়ে দাঁড়াতে পারি তোমার প্রদীপ্ত মশাল।
আমার অন্তরের ভিতর থেকে উঠছে এক নীরব স্তুতি, প্রাচ্যদেশের ধূপের শুভ্র ধোঁয়া যেন ৷
পূর্ণ আত্মদানের প্রশান্তি নিয়ে আমি তোমাকে প্রণাম জানাই এই ভোরের মুখে ৷
বছর: ১৯১৪
২৪ জানুয়ারী ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
হে আমাদের সত্তার একমাত্র সদস্তু, প্রেমের রাজরাজ, জীবনের উদ্ধারক, প্রতি মুহূর্তে, প্রতি জিনিসের মধ্যে কেবল তোমারই বোধ যেন আমার জেগে থাকে। একান্ত তোমার জীবনে জীবন মিশিয়ে যখন আমি না চলি, তখন যেন হয় আমার শ্বাসরোধ; ধীরে ধীরে আমি যেন নিভে যাই। তুমি আমার জীবনের একমাত্র হেতু, আমার একমাত্র লক্ষ্য, আমার একমাত্র আশ্রয়। আমি যেন ভীরু পক্ষিশাবকের মত, এখনও ডানার উপর পূর্ণ নির্ভর হয়নি, উড়ে চলতে শঙ্কা হয়। হে ভগবান, আমায় দাও সামর্থ্য, উঠে যেন যাই উড়ে, যাতে তোমার মধ্যে গিয়ে এক হয়ে যেতে পারি শেষবারের মতো।
বছর: ১৯১৪
১ ফেব্রুয়ারী ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
তোমার দিকে ফিরে দাঁড়াই আমি – সর্বত্র তুমি, সকলের মধ্যে, আবার সকলের বাইরে, সকলের সারবস্তু তুমি, আবার সকলের নিঃসম্পর্কিত তুমি। সকল শক্তি জমাট বেঁধেছে তোমাকে কেন্দ্র করে, সজাগ ব্যষ্টি সব তুমি সৃষ্টি করেছ। তোমার দিকে ফিরে দাঁড়াই, তোমাকে বন্দনা করি, হে জগতের মুক্তিদাতা! তোমার দিব্যপ্রেমের মধ্যে মিশে গিয়ে, আমি দৃষ্টিপাত করি পৃথিবীর উপর, তার জীবকুলের উপর, দেখি এই পদার্থের স্তূপ নিয়ত রূপগ্রহণ করে, বিনাশ পায়, পুনরায় নবীভূত হয়, এই যে বহুর সমাবেশে স্তূপ সব গড়ে ওঠে, আবার তৎক্ষণাৎ মিলিয়ে যায়, এই যে সব সত্তা যাদের ধারণা তারা সচেতন শাশ্বত ব্যষ্টিরূপ, বস্তুত কিন্তু তারা একটি নিঃশ্বাসের মতই নশ্বর, সকলেই তারা একই ধরনের, পার্থক্য যতই হোক, তারা সকলে চিরকাল পুনঃপুনঃ প্রকাশ করে চলেছে একই সব কামনা, একই সব প্রেরণা, একই সব তৃষ্ণা, সেই একই সব অজ্ঞানাচ্ছন্ন প্রমাদ।
তবে কখন কখন ব্যষ্টিবিশেষের মধ্যে তোমার পরাজ্যোতি দীপ্ত হয়ে ওঠে, তাকে আশ্রয় করে জগতের উপর বিকীর্ণ হয়, তখন কিছু বুদ্ধি, কিছু জ্ঞান, কিছু নিঃস্বার্থ নিষ্ঠা, পৌরুষ ও কারুণ্য বহুর হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করে, মস্তিষ্কের রূপান্তর ঘটায়, জীবনের পীড়াকর নির্মম চক্রে অন্ধ অজ্ঞান যারা বাঁধা পড়েছে তাদের কারো কারো মুক্তি এনে দেয় তা থেকে।
কিন্তু নাগরিক জীবন, তথাকথিত সভ্যতা মানুষকে আজ যে নিদারুণ মতিভ্রমের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে, তা থেকে তাদের উদ্ধার করতে হলে দরকার নয় কি এমন উত্তুঙ্গ মহিমা অতীতে যতদূর কখন পৌঁছান হয়নি, এমন মাহাত্ম্য এমন জ্যোতি যার নাম অপরূপ আশ্চর্য? প্রয়োজন নয় কি এমন শক্তি যুগপৎ যা বিরাট ও মধুতম মধুর? তাতেই ফিরিয়ে আনতে পারে এই সব একরোখা প্রাণকে, তারা যে তীব্র যুদ্ধ করে চলেছে তুচ্ছ নির্বোধ আত্মতৃপ্তির জন্যে তা থেকে; যে উত্তাল বিক্ষোভরাশি তার মায়াদ্যুতির পিছনে লুকিয়ে রেখেছে মৃত্যুকে, তা থেকে সেই শক্তিই মুক্ত করে দিতে পারে, তোমার সুছন্দ বিজয়-বৈজয়ন্তীর দিকে ফিরিয়ে ধরতে পারে সকলকে।
ভগবান, সনাতন অধিপতি, আলো এনে ধর, হাত ধরে নিয়ে চল, দেখাও পথ চলেছে যা তোমার দিব্যবিধানের প্রতিষ্ঠা, তোমার কর্মের পরিপূর্ণতার অভিমুখে।
নীরবে তোমায় আমি পূজা করি। ভক্তিসমাহিতচিত্তে রয়েছি তোমার দিকে কান পেতে।
১৪ ফেব্রুয়ারী ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
সমস্ত পৃথিবীর উপর নামে যেন শান্তি, শান্তি…
সকলেই যেন সাধারণ চেতনা থেকে রক্ষা পায়, স্থূল বস্তুর উপর আসক্তি থেকে মুক্ত হয়। তোমার দিব্য সান্নিধ্যের জ্ঞান যেন তাদের আসে, তোমার পরাচেতনার সঙ্গে তাদের চেতনা যেন সংযুক্ত হয়, আর ফলে আসে যে শান্তির পূর্ণতা তার আস্বাদ যেন পায় ৷
ভগবান, তুমি আমাদের সত্তার একচ্ছত্র অধীশ্বর। তোমার বিধানই আমাদের বিধান। আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমরা আকাঙ্ক্ষা করি যেন তোমার শাশ্বত চেতনার সঙ্গে আমাদের চেতনা একীভূত করতে পারি, যাতে প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে প্রত্যেক মুহূর্তে তোমারই দিব্যকর্ম আমরা সংসিদ্ধ করে তুলতে পারি।
ভগবান, দৈনন্দিন যোগাযোগের সকল দুশ্চিন্তা থেকে আমাদের মুক্ত কর, মুক্ত কর নিত্যকার বহির্মুখী দৃষ্টি থেকে। এখন আমরা যেন তোমারই চোখ দিয়ে দেখি সব, কেবল তোমারই ইচ্ছায় যেন কর্ম করি। তোমার দিব্যপ্রেমের জীবন্ত শিখারূপে আমাদের নূতন করে গড়ে তোল ।
শ্রদ্ধাভরে, ভক্তিভরে, সর্বাঙ্গ সানন্দে উৎসর্গ করে, আমি আমাকে নিবেদন করছি, হে ভগবান, যাতে তোমার বিধান সার্থক হয়ে ওঠে।
শান্তি – শান্তি নামে যেন সারা পৃথিবীর উপর।…
১৫ ফেব্রুয়ারী ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
একমাত্র সদবস্তু তুমি, ভগবান, আলোর আলো, জীবনের জীবন, জগত্তারণ হে পরম প্রেম! এই অনুমতি দাও যেন তোমার নিরন্তর সান্নিধ্য ক্রমে পূর্ণতরভাবে আমার জাগ্রত চেতনায় ফুটে ওঠে, যার ফলে আমার সকল কর্ম তোমার দিব্যবিধানের অনুগত হয়, যেন তোমার ইচ্ছা আর আমার ইচ্ছার মধ্যে কোনই পার্থক্য না থাকে। এই যে মায়াময় চেতনা, এই যে অলীক খেয়ালের জগৎ তা থেকে আমরা মুক্তি পেতে চাই যাতে আমাদের চেতনাকে তুমিই যে পরাচেতনা তার সঙ্গে একীভূত করতে পারি।
লক্ষ্যে পৌঁছবার সংকল্পকে আমাদের দৃঢ়নিষ্ঠ করে ধর, সকল জড়তা সকল অবসাদ ঝেড়ে ফেলবার জন্যে দাও আমাদের স্থিরতা, কঠিনতা ও সাহস।
ভগবান, মিনতি করি তোমায়, আমার সত্তার মধ্যে সবকিছু যেন তোমার সঙ্গে এক হয়ে যায়, আমি যেন হয়ে উঠি সেই প্রেমের প্রজ্বলন্ত শিখা যারই মধ্যে রয়েছে তোমার পরা কর্মগতির পূর্ণ চেতনা ৷
৭ মার্চ ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
“কাগামারু” জাহাজে :
কাল তুমি আমাদের কাছে এসেছিলে পরমাশ্চর্য অভয়রূপে। তোমার অনুজ্ঞায় অতি স্থূল প্রকাশেও জয়ী হয়েছে তোমারই বিধান। হিংস্রতার প্রত্যুত্তরে তুমি এনে দিয়েছ প্রশান্তি, নির্দয়তার পরিবর্তে সহৃদয়তা; যেখানে ঘটতে পারত এমন দুর্গতি যার কোন প্রতিকার নেই, সেখানে তোমার শক্তির মহিমা প্রকট হয়েছে। হে ভগবান, কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ হৃদয় নিয়ে তোমার আবির্ভাব স্বাগত করি। অভ্রান্ত চিহ্ন বলে একে আমি গ্ৰহণ করেছি, তোমার নাম নিয়ে তোমার জন্যে জীবনধারণ করবার, চিন্তা করবার, কাজ করবার শক্তি আমাদের যে অধিগত হবে কেবল ভিতরের ভাবে নয়, ইচ্ছায় নয়, পরন্তু কার্যত, একটা অখণ্ড সিদ্ধির মধ্যে।
আজ প্রত্যূষে আমার প্রার্থনা সেই একই আস্পৃহা নিয়ে তোমার দিকে উঠে চলেছে: তোমার প্রেমকে জীবনে ফলিত করবে, চারিদিকে ছড়িয়ে দেবে বলে এত প্রবলবেগে এত সাফল্যের সঙ্গে যে যারাই আমাদের সংস্পর্শে আসবে তারা সকলেই পাবে বলবীর্য, নবজীবন, জ্ঞানের আলো। শক্তি চাই – জীবনকে নিরাময় করবার জন্যে, দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তিলাভের জন্যে, শান্তি আর অটল বিশ্বাস গড়বার জন্যে, মনস্তাপ মুছে ফেলে তার স্থানে সেই একমাত্র সত্যকার সুখ স্থাপন করবার জন্যে, যা রয়েছে তোমার মধ্যে, যার নেই নির্বাণ। ...হে ভগবান, হে অনুপম বন্ধু, সর্বশক্তিমান প্রভু, আমাদের সমগ্র সত্তার মধ্যে প্রবেশ কর, তাকে রূপান্তরিত করে চল, যতদিন না আমাদের অন্তরে, আমাদের আশ্রয় করে একমাত্র তুমিই থাক জীবন্ত হয়ে।
৮ মার্চ ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
এই প্রশান্ত সূর্যোদয়ের সম্মুখে আমি - সব নীরব শান্তিময় আমারb অন্তরে। এমন যে মুহূর্ত, তোমাতে সচেতন হয়ে উঠেছি আমি, একমাত্র তুমিই আমার মধ্যে। আমার বোধ হল জাহাজের সকল যাত্রীকে আমি গ্রহণ করেছি, সমান ভালবাসা দিয়ে তাদের ঘিরে রেখেছি, যাতে প্রত্যেকের মধ্যে তোমার চেতনার কিছু একটু জেগে উঠতে পারে। তোমার দিব্যশক্তি তোমার অজেয় জ্যোতি এত প্রবলভাবে প্রায়শ অনুভব করিনি – আর একবার অখণ্ড হয়ে উঠল আমার নিষ্ঠা, অমিশ্র আমার সানন্দ সমৰ্পণ ।
হে ভগবান, সকল বেদনায় স্বস্তি দাও তুমি, তুমি দূর করে দাও সকল অজ্ঞান, হে অনুপম ভিষক্, এই জাহাজে যারা আশ্রয় নিয়েছে তাদের হৃদয়ে নিরন্তর আসীন হও, যাতে তোমার মহিমা আবার একবার প্রকাশ পায় ।
৯ মার্চ ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
তোমার জন্যে তোমার মধ্যে যাদের জীবন তারা তাদের স্কুল পারিপার্শ্বিক, তাদের দৈনন্দিন কর্মসূচী, স্থানীয় জলবায়ু, আবেষ্টন সব পরিবর্তন করতে পারে, তবুও সর্বত্র তারা পায় একই আবহাওয়া; অন্তরে অন্তরে, তোমাতে নিমগ্ন তাদের চিন্তার মধ্যে তারা বয়ে নিয়ে চলে সে-আবহাওয়া। সর্বত্রই তারা অনুভব করে তারা রয়েছে নিজের ঘরে, কারণ সর্বত্র তারা রয়েছে তোমারই ঘরে। জিনিসের দেশের নূতনত্ব, তাদের অভাবনীয়ত্ব, তাদের শোভা দেখে তারা আর চমৎকৃত হয় না। কারণ, তারা দেখে সকলের মধ্যে তুমিই বাস কর, আর যে চিরস্থির জ্যোতি সর্বদা রয়েছে তাদের সঙ্গে, ক্ষুদ্রতম ধূলিকণারও মধ্যে তা পরিস্ফুট। সমস্ত পৃথিবী তোমার গুণগান করে: সকল অন্ধকার দৈন্য অজ্ঞান সত্ত্বেও, ও-সবেরই ভিতর দিয়ে তবু তোমারই প্রেমের মহিমা আমরা সাক্ষাৎ করি, তারই সঙ্গে রন্তর সর্বত্র সংযোগ স্থাপন করি।
হে ভগবান, হে মধুর রাজরাজ, এই সব জিনিসই রয়েছে আমার নিত্য অনুভবে এই জাহাজের উপরে – এ হল যেন অপরূপ শান্তির ধাম, পুণ্য-মন্দির – তোমারই পূজা দিয়ে যেন সে চলেছে অসাড়
অবচেতনার তরঙ্গরাশি ভেদ করে। সে অবচেতনা আমাদের জয় করতে হবে, তাকে তোমার দিব্যসত্তার চেতনায় জাগ্রত করে তুলতে হবে।
পুণ্য সে-দিন যে-দিন তোমায় আমি জানতে পেরেছি, হে অনির্বচনীয় শাশ্বত!
সকল দিনের মধ্যে পুণ্যতম সে-দিন যে-দিন অবশেষে জাগ্রত হয়ে পৃথিবী তোমায় জানবে, কেবল তোমারই জন্যে জীবনধারণ করবে!
২৫ মার্চ ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
চিরদিন যেমন তেমনি নীরব অদৃশ্য অথচ সর্বশক্তিমান তোমার কর্মধারা সক্রিয় হয়ে উঠল। যাদের চেতনা মনে হয়েছিল সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ, সেইসব জীবের মধ্যে তোমার দিব্যজ্যোতির একটা অনুভূতি জাগ্রত হয়েছে। আমি বেশ জানতাম, তোমার সান্নিধ্যকে ডাকা কখন বৃথা যায় না । হৃদয়ে আন্তরিকতা নিয়ে যদি তোমার সঙ্গে আমি সংযোগ স্থাপন করি – যে কোন আধারের ভিতর দিয়ে, তা স্থূল শরীর হোক অথবা সমগ্র মানবজাতি হোক – তাহলে, সেই আধার দেখবে অজ্ঞান সত্ত্বেও তার অচেতনা সম্পূর্ণ রূপান্তরিত হয়ে চলেছে। কিন্তু যখন এক বা একাধিক ব্যষ্টি-আধারের সজ্ঞানে রূপান্তর সাধন হয়, যখন ভস্মাচ্ছাদিত অগ্নিশিখা অকস্মাৎ বহির্গত হয়ে সমগ্র সত্তাকে আলোকিত করে, তখন পরম আনন্দে তোমার অবাধ ক্রিয়াকে স্বাগত করি, আর একবার তোমার অমোঘ শক্তির প্রমাণ হল এ ঘোষণা করি; স্বভাবতঃই তখন আশা জাগে মানুষের অন্যান্য সুখরাজির সঙ্গে সত্যকার সুখের এক নূতন
সম্ভাবনা যোগ হতে চলেছে।
ভগবান, আমার ভিতর থেকে তোমার দিকে এক তীব্র উদ্গীথ উঠে চলেছে, তাতে প্রকাশ পেয়েছে দুঃখকাতর মানবজাতির কৃতজ্ঞতা। সে- মানুষকে তুমি আলোকিত, রূপান্তরিত, মহিমান্বিত করে চলেছ, তাকে তুমি দিয়েছ দিব্যজ্ঞানের শান্তি।
১০ এপ্রিল ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
সহসা আবরণ ছিন্ন হয়ে গিয়েছে, দিজ্মণ্ডল উদ্ভাসিত। এই নির্মল দর্শন লাভ করে আমার সমগ্র সত্তা কৃতজ্ঞতায় পরিপ্লুত, তোমার পদতলে নিজেকে ধরে দিয়েছে। তবুও এই গভীর, এই অখণ্ড আনন্দ সত্ত্বেও, সব অচঞ্চল, সব শান্তিময় শাশ্বতের শান্তিতে। মনে হয় আমার নেই কোন সীমা, শরীরের বোধ পর্যন্ত আর নেই, নেই কোন সংবেদন, কোন অনুভব, কোন চিন্তা... আছে শুধু নির্মল বিশুদ্ধ প্রশান্ত বিশালতা, আলোকে প্রেমে অনুস্যূত, অনির্বচনীয় আনন্দে পরিপূর্ণ – এ ছাড়া এখন আমি যেন আর কিছুই নই; আর এ-আমি আমার পূর্বের স্বার্থপর সীমাবদ্ধ আমি হতে এত বিভিন্ন যে বলতে পারি না তা আমি না তুমি, হে ভগবান, হে আমাদের পরম ভাগ্যবিধাতা!
সর্বত্র সবই যেন হয়ে উঠেছে বীর্য সাহস বল এষণা, অসীম মাধুৰ্য, অতুলনীয় কারুণ্য…
শেষ কয়দিনের চেয়ে এ অনুভব আরো প্রবল, অতীতের মৃত্যু ঘটেছে, যেন নূতন এক জীবনের কিরণরাজি তাকে গ্রাস করেছে। এই খাতাটির কয়েকখানি পৃষ্ঠা পড়তে গিয়ে যখন পিছনে শেষবার দৃষ্টিপাত করলাম, তখন সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হলাম যে মৃত্যু সত্যই হয়েছে, তখন একটা গুরুভার থেকে মুক্ত হয়ে, হে ভগবান, তোমার সম্মুখে উপস্থিত হলাম শিশুর অকুণ্ঠ সরলতা ও নগ্নতা নিয়ে... সর্বদা একমাত্র যে বস্তু অনুভব করি তা হল সেই শান্ত নির্মল বিশালতা। ...হে ভগবান, তুমি আমার প্রার্থনা শুনেছ, তোমার কাছে যা চেয়েছি তা তুমি দিয়েছ - “আমি” চলে গিয়েছে, এখন রয়েছে কেবল তোমার সেবায় নিযুক্ত, অনুগত যন্ত্র, তোমার অনন্ত চিরন্তন কিরণরাজিকে সংহত ও প্রকাশিত করবার কেন্দ্র । তুমি আমার জীবন গ্রহণ করেছ, তোমার নিজের করে নিয়েছ, তুমি আমার ইচ্ছাকে গ্রহণ করেছ এবং তোমার ইচ্ছার সঙ্গে মিলিয়ে ধরেছ, আমার ভালবাসাকে গ্রহণ করেছ, তোমার ভালবাসার সঙ্গে এক করে নিয়েছ, আমার চিন্তাকে গ্রহণ করেছ, তার পরিবর্তে স্থাপন করেছ তোমার পূৰ্ণ চেতনা ৷
শরীর মুগ্ধ হয়ে ধূলায় মাথা নত করেছে, নীরব আত্মহারা পূজায়। কিছুই নেই সেখানে, আছ কেবল তুমি, তোমার অক্ষয় শান্তির মহিমা নিয়ে ।
১৭ এপ্রিল ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
পণ্ডিচেরী :
হে সর্বশক্তিমান অধীশ্বর, একমাত্র সদবস্তু, দেখো যেন আমার হৃদয়ের আমার চিন্তার মধ্যে কোন ভুল, কোন আবরণ, কোন মারাত্মক অজ্ঞান লুকিয়ে প্রবেশ না করে।…
কর্মে ব্যক্তিত্বই হল তোমার ইচ্ছার তোমার শক্তির অনিবার্য ও অপরিহার্য আশ্রয়। ব্যক্তিত্ব যত সমর্থ, যত বহুমুখী, যত বীর্যবন্ত, যত ব্যষ্টিত্বময়, যত সচেতন হবে, যন্ত্রের সেবা তত সতেজ ও সফল হয়ে উঠবে। কিন্তু ব্যক্তিত্বের ধর্মই আবার ব্যক্তিত্বকে অবাধে টেনে নিয়ে যায় এই নিদারুণ ভ্রমের মধ্যে যে তার আছে একটা পৃথক সত্তা, ফলে ক্রমে সে আবরণ হয়ে দাঁড়ায়, তোমার আর যার উপরে তুমি কাজ করতে চাও তার মধ্যে। আবরণ হয় গোড়ার দিকে নয়, অভিব্যক্তির পথে নয়, ফিরবার পথে, প্রত্যর্পণের মধ্যে। তোমার একনিষ্ঠ সেবক না হয়ে, অবলম্বন না হয়ে, তোমার প্রাপ্য তোমাকে যথাযথ ফিরিয়ে না দিয়ে অর্থাৎ তোমার কর্ম অনুসারে শক্তির স্ফুরণ হতে না দিয়ে, ব্যক্তির প্রবৃত্তি হয় নিজের জন্যে এই শক্তির কিছু রেখে দিতে, কারণ তার ধারণা হয় “আমি এ-কাজ করছি ও-কাজ করছি, আমিই প্রশংসার পাত্র।” হে দুষ্কর্মী মায়া, হে তামসী মিথ্যা, এখন তোমরা ধরা পড়েছ, মুখোশ তোমাদের খসে পড়েছে। এইতো সেই করাল কীট, কর্মের ফল যা খেয়ে ফেলে, তার পরিণাম ব্যর্থ করে দেয়।
হে ভগবান, মধুময় রাজরাজ, অদ্বিতীয় সদবস্তু, “আমি” এই বোধকে দূর কর। এখন বুঝতে পেরেছি যতদিন বিশ্বপ্রকাশ থাকবে ততদিন “আমি”ও থাকবে তোমার প্রকাশের জন্যে। “আমি”কে লোপ করে দেওয়া, এমনকি তাকে খর্ব করা দুর্বল করা অর্থ তোমার প্রকাশের যন্ত্র থেকে তোমাকে বঞ্চিত করা, অংশত হোক আর সমগ্রত হোক। যে জিনিস সম্পূর্ণ নির্মূল করতে হবে কোন শেষ আর না রেখে তা হল এই মায়াময় চিন্তা, এই মায়াময় অনুভব, এই মায়াময় বোধ যে আমি হলাম পৃথক এক বস্তু। কোন মুহূর্তে কোন অবস্থায় ব ভুললে চলবে না যে তোমার বাহিরে আমাদের “আমি”র কোন সত্য নেই ৷
হে আমার মধুময় রাজা, আমার দেবাদিদেব অধীশ্বর, আমার হৃদয় হতে এই মায়াকে উৎপাটন কর, যাতে তোমার সেবক শুদ্ধ হয়ে একনিষ্ঠ হয়ে তোমার কাছে সম্পূর্ণ ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে যা-কিছু তোমার প্রাপ্য। নীরব হয়ে গিয়ে এই অজ্ঞানকে যেন আমি দেখতে পারি, বুঝতে পারি, চিরকালের জন্যে দূর করে দিতে পারি। আমার হৃদয় হতে অজ্ঞানের ছায়া অপসারিত কর, তোমার আলো যেন সেখানে বিরাজ করে, তার একচ্ছত্র অধীশ্বররূপে।
১২ মে ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
ক্রমেই আমার যেন স্পষ্ট বোধ হয়ে উঠছে যে আমরা আমাদের কর্মের সেই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি যখন অতীত-প্রয়াসের ফল দেখা দিতে থাকে – এমন একটা পর্যায় যখন আমরা কাজ করি তোমার বিধান অনুসারে, ততখানি যতখানি সে-বিধান আমাদের সত্তাকে অধিকার করতে পেরেছে, যদিও হয়তো সজ্ঞানে এই বিধানকে ধরবার মত অবকাশ তখন থাকে না।
আজ সকালে আমার এক অভিজ্ঞতা হল: আমি দ্রুত চলে গেলাম গভীর হতে গভীরে, তারপর যেমন সচরাচর আমার হয়ে থাকে, তোমার চেতনার সঙ্গে আমার চেতনা সংযুক্ত হয়ে গেল, তোমারই মধ্যে রয়ে গেলাম, অর্থাৎ এক তুমিই রয়ে গেলে – কিন্তু তোমার ইচ্ছাবল আমার চেতনাকে বাহিরের দিকে টেনে আনল যে কর্ম উদ্যাপন করতে হবে তার দিকে, আর তুমি আমায় বললে: যে যন্ত্রের আমার প্রয়োজন তোমাকে তাই হতে হবে।
এ কি তবে সেই অন্তিম ত্যাগ নয়, তোমার সঙ্গে একত্বের ত্যাগ, সেই মধুর বিশুদ্ধ আনন্দের ত্যাগ, যে আনন্দ আসে তোমার আর আমার মধ্যে কোন পার্থক্য না রাখবার ফলে, প্রত্যেক মুহূর্তে এই জ্ঞান রাখবার ফলে – বুদ্ধিগত জ্ঞান নয়, কিন্তু একটা অখণ্ড অভিজ্ঞতা – যে তুমিই একমাত্র সবস্তু, আর বাকি শুধু বাহ্যিক মূর্তি, মায়ারূপ। বাহ্যসত্তা অনুগত সেবক হয়ে উঠুক, যে ইচ্ছাশক্তি তাকে চালায় তার সম্বন্ধে সচেতন থাকবার প্রয়োজন সে সত্তার কিছু নেই – অনায়াসে মেনে নিলাম। কিন্তু তার জন্যে আমাকে কেন সেই যন্ত্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ একীভূত হয়ে যেতে হবে? বরং এই “আমি” তোমার সঙ্গে কেন এক হয়ে যায় না, তোমার পূর্ণ পরাচৈতন্যের জীবন লাভ করে না?
প্রশ্ন করি বটে, কিন্তু তার জন্যে দুশ্চিন্তা করি না কিছু। আমি জানি সবই তোমার ইচ্ছা অনুসারে। তাই শুদ্ধ চিত্তে তোমার আরাধনা করি, তোমার ইচ্ছার কাছে পরম আনন্দে নিজেকে ছেড়ে দিই। ভগবান, তুমি আমাকে দিয়ে যা চাও তাই হব আমি, সজ্ঞান হই আর অজ্ঞান হই, শুধুই যন্ত্র হই যেমন শরীরটি, অথবা হই পরাচেতনা তুমি যা ।
কি মধুর, কি শান্তিময় আনন্দ হয় আমার, যখন বলতে পারি, “সব ঠিক”, যখন বোধ করি তুমি জগতের মধ্যে কাজ করে চলেছ, যারাই যেখানে তোমার বাহন হতে পেরেছে তাদের ভিতর দিয়ে।
তুমি সকলের একচ্ছত্র প্রভু, তুমি অগম্য অজ্ঞেয় শাশ্বত পরাৎপর সদবস্তু।
হে অনুপম একত্ব! তোমার মধ্যে আমি লীন। …
২১ মে ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
সকল প্রকাশের বাহিরে, শাশ্বতের অক্ষয় নীরবতার মধ্যে আমি রয়েছি তোমাতে, হে ভগবান, চিরস্থির আনন্দ তুমি। তোমার শক্তি ও অনুপম জ্যোতি হতে গৃহীত যে বস্তু দিয়ে জড় পরমাণু সকলের কেন্দ্র ও বাস্তব-সত্তা গড়া হয়েছে তারও মধ্যে তোমাকে ফিরে পাই আবার আমি। তাইতো তোমার দিব্য সান্নিধ্য বর্জন না করে তোমার পরাচেতনায় আমি ডুবে যেতে পারি, আবার তবু তোমাকে দেখতে পারি আমার আধারের আলোকোজ্জ্বল কণারাজির মধ্যে। আর এখন অন্তত এইতো তোমার জীবনের, তোমার দীপনের পরম পূর্ণতা ।
আমি তোমায় দেখছি, আমি হয়েছি তুমিই, এই দুই শেষ-প্রান্তের মাঝে আমার প্রেম তীব্র আস্পৃহা নিয়ে চলেছে তোমার দিকে।
২২ মে ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
সত্তার সকল অবস্থায়, জীবনের সকল ক্ষেত্রে, একের পর একটিতে যখন অবস্তু হতে সবস্তুকে চিনে নিয়েছি, তোমার অদ্বিতীয় সত্তার অখণ্ড পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা লাভ করেছি তখন সেই পরাচেতনার শিখর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে হবে উপাদানসমষ্টি এই ব্যষ্টির দিকে – যাকে পৃথিবীর উপর তোমার প্রকাশের যন্ত্র হতে হবে, তার ভিতর দেখতে হবে কেবল তোমাকেই কারণ, তুমিই তার একমাত্র সত্য-সত্তা। এই আধারের প্রতিটি কণা তবে জেগে উঠবে, তোমার সমুচ্চ প্রভাব গ্রহণ করতে সমর্থ হবে; অজ্ঞান, অন্ধকার সব দূর হয়ে যাবে, সত্তার মূল-চেতনা থেকে শুধু নয়, তার অতি-বাহ্য প্রকাশের ধারা হতে পর্যন্ত। রূপান্তরের এই সাধনা যখন পূর্ণ হবে, সর্বাঙ্গসুন্দর হবে তখনই প্রকাশ পাবে তোমার পূর্ণ শক্তি, পূর্ণ জ্যোতি, পূর্ণ প্রেম।
ভগবান, এ কথাটি আমাকে ক্রমেই স্পষ্ট করে বুঝিয়ে চলেছ। এই পথেই হাত ধরে নিয়ে যাও আমার। আমার সমগ্র সত্তা, তার ক্ষুদ্রতম অণু অবদি আকাঙ্ক্ষা করে তোমার সান্নিধ্যের পরাজ্ঞান, তার সঙ্গে পূর্ণ गान। সকল नागा দূর হয়ে যাক, অজ্ঞান-অন্ধকারকে সরিয়ে দিয়ে আসুক সর্বন তোমার দিব্যজ্ঞান। মূল চেতনাকে, সত্তার আপন সন্ধ্যাকে যেমন আলোকিত করেছে, তেমনি আলোকিত কর বাহ্য উপাদান পর্যন্ত। সমগ্র ব্যক্তিসত্তাটি, তার আদি আরম্ভ, তার সারপদার্থ থেকে তার সর্বশেষ রূপায়ণ এই জড়তম দেহ অবধি সব যেন এক হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ সিদ্ধির মধ্যে, তোমার অদ্বিতীয় গদবপুর সর্বাঙ্গীন প্রকাশের মধ্যে।
তোমার লান আর তোমার জ্যোতি আর তোমার প্রেম নয় এমন কিছুই নেই বিশ্বে।
সব যেন জ্যোতিময় হয়. রূপান্তরিত হয় তোমার সত্যের জ্ঞানলাভ করে।
তোমার দিনাােম আমার সত্তাকে পরিগ্লাবিত করেছে, প্রতি কোষ তোমার আলোকে উত্যাসিত, তোনেছে তোমায়, তুমিই হয়ে গিয়েছে; তাই পরমানন্দে আত্মহারা সব।
২৬ মে ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
উপরে তুফান – সাগর উত্তাল। ঢেউয়ে ঢেউয়ে সংঘর্ষ, একটির মাথায় আর একটি বিপুল শব্দে ভেঙ্গে পড়ছে পরস্পরের গায়ে – ঠিক সেই অবসরে, এই উন্মত্ত জলরাশির নীচে রয়েছে আবার বিপুল প্রসার,স্থির, প্রশান্ত, সহাস্য – উপরের চাঞ্চল্য সে দেখছে তাকিয়ে একটা অপরিহার্য ঘটনা হিসাবে ।
জড়কে একান্তভাবে মন্থন করা চাই যাতে সে ভগবানের পূর্ণ জ্যোতি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। বিক্ষুব্ধ বাহ্যরূপের পিছনে, দ্বন্দ্বের, দারুণ সংঘর্ষের পিছনে চৈতন্য তার স্থিরাসনে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ, বাহ্যসত্তার সকল ক্রিয়াবলী নিরীক্ষণ করছে, হস্তক্ষেপ করে কেবল তখনি যখন কোথাও দিক বা স্থান সংশোধন করা দরকার হয়, যাতে খেলাটির মধ্যে নাটকীয় আতিশয্য না এসে পড়ে। এই হস্তক্ষেপ কখন দৃঢ়, কখন-বা কিছু রূঢ়, আবার কখন শ্লেষময়, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবার জন্যে তাগিদ, কিংবা তা যেন একটুখানি ব্যঙ্গ, কিন্তু সর্বদা সেই একই মধুর প্রবল প্রশান্ত প্রসন্ন কারুণ্যে পরিপূর্ণ ।
নীরবতার মধ্যে আমি দেখলাম তোমার অসীম সনাতন দিব্যানন্দ তারপর তোমার দিকে ধীরে উঠে চলল আঁধারের মধ্যে দ্বন্দ্বের মধ্যে এখনো পড়ে আছে যে-বস্তু তার এই প্রার্থনা: মধুর রাজরাজ! পরম জ্ঞানদাতা, পরম শুদ্ধিদাতা, আমার যা-কিছু উপাদান, যা-কিছু কর্ম সব যেন নিরন্তর হয় কেবল তোমারি প্রেমের, তোমার সমূর্ধ্ব পরমা প্রশান্তির প্ৰকাশ ৷
আর হৃদয়ের মধ্যে গান গেয়ে চলে তোমার মহা-মহিমায় ভরপূর পরম পুলক ।
২৭ আগস্ট ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
হতে পারা যায় যদি সেই সমর্থ অসীম অতল দিব্যপ্রেম, সত্তার সকল ক্রিয়ার মধ্যে, সকল ভূমির মধ্যে... তোমার কাছে এই প্রার্থনাই আমার, হে ভগবান! আমি যেন প্রজ্বলিত হয়ে উঠি এই সমর্থ অসীম অতল প্রেমরূপে সকল ক্রিয়ার মধ্যে, সকল ভূমির মধ্যে! এই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে আমায় পরিণত কর, তাতে যেন সমস্ত পৃথিবী বিশুদ্ধ হয়ে ওঠে।
হতে পারি যদি তোমার সেই অনন্তভাবের প্রেম।....
৩১ আগস্ট ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
এই যে ভীষণ অব্যবস্থা, এই যে দারুণ ধ্বংস, এরই মধ্যে লক্ষ্য করা যেতে পারে চলেছে বিপুল এক প্ৰয়াস – তার প্রয়োজন পৃথিবীতে নূতন বীজ রোপণের জন্যে; সে বীজ শোভন শীষ সব তুলে দাঁড়াবে, জগতে এনে দেবে নবজাতি-রূপ শস্যসম্ভার। ...এ ভবিষ্য-দৃষ্টি পরিষ্কার – তোমার দিব্যবিধানের ধারা এমন স্পষ্ট আঁকা যে সকল কর্মীর হৃদয়ে পূর্ণ শান্তি এসে আসন গ্রহণ করেছে। সন্দেহ আর নেই, নেই সংশয়, সন্তাপ নেই, নেই অধীরতা। দেবকর্ম চিরকাল সংসিদ্ধ হয়ে চলেছে তার ঋজুপথে, সকল বাধাবিপত্তি আপাতবিরোধের মধ্যে দিয়ে, কুটিল পথের সকল বিভ্রান্তি পার হয়ে। আর এই যে সব স্থূল ব্যক্তিসত্তা, অনন্ত পারম্পর্যে অনবধারণীয় মুহূর্ত সব, এরা জানে যে মানবজাতিকে তারা এক পা করে এগিয়ে দিয়েছে, অনিবার্য পরিণাম সম্বন্ধে তাদের দুশ্চিন্তা নেই, সাময়িকভাবে আপাতত ফল যেমনই হোক না। তারা সকলে তোমার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছে, হে শাশ্বত অধীশ্বর! তোমারও সঙ্গে তারা নিজেদের যুক্ত করেছে, হে বিশ্বজননী! আর, সকল প্রকাশের ঊর্ধ্বে যে সবস্তু আবার বিশ্বপ্রকাশই যে সদ্বস্তু তাদের সঙ্গে এই যুগল সংযোগের সহায়ে তারা আস্বাদন করেছে পরম নিঃসংশয়তার সীমাহীন আনন্দ.....
শান্তি, শান্তি, শান্তি বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে ...
যুদ্ধ হল বাহ্যরূপ মাত্র,
বিক্ষোভ হল ভ্রান্তি মাত্ৰ,
শান্তিই রয়েছে অব্যয় অক্ষয়।
মা জননী – আমিই তো সে জননী মা – যুগপৎ সংহারকর্ত্রী সৃষ্টিকর্ত্রী তুমি!
বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড তোমার বুকের মধ্যে রয়েছে তার বহুরূপ জীবনলীলা নিয়ে আর তুমিও তার ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র কণার মধ্যে রয়েছ তোমার সমস্ত বিশালতা নিয়ে।
তোমার আনন্ত্য তার আস্পৃহা ধরে ঊর্ধ্বে উঠে চলেছে, কখন যা প্রকাশ পায়নি তার দিকে, এই মিনতি নিয়ে যাতে পূর্ণতর সুষ্ঠুতর প্রকাশ নিরন্তর দেখা দেয়।
সেই সঙ্গেই আবার সব অস্তি, এক ত্রিধা ও অখণ্ডধর্মী সমগ্রচেতনার মধ্যে, যুগপৎ, ব্যক্তিগত, সার্বভৌম, অনন্ত।
১ সেপ্টেম্বর ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
জগৎ-জননী! কি আকুলতা নিয়ে, কি জ্বলন্ত ভালবাসা নিয়ে আমি ছুটে গেলাম তোমার দিকে, তোমার গভীরতম চেতনার মধ্যে, তোমার যে পরম প্রেমের পূর্ণ আনন্দের সত্তা তার মধ্যে – সেখানে তোমার বাহুপাশে গাঢ়সংলগ্ন হয়ে গেলাম এমন তীব্র প্রেমাবেগে যে আমি শেষে তুমিই হয়ে উঠলাম। তখন নিবিড় কণ্ঠ এক শুনলাম “আমাদের” সেই মূক রভসের নীরবতার মধ্যে – সে-কণ্ঠ বলল: “তাদের দিকে ফিরে দাঁড়াও, যাদের প্রয়োজন তোমার ভালবাসা।” তখন আমার চোখে ভেসে উঠল চেতনার সোপানাবলী, জগতের পারম্পর্য – তাদের কোন কোনটি প্রোজ্জ্বল সুব্যবস্থিত, জ্যোতির্ময়, সুপরিচ্ছন্ন – জ্ঞান সেখানে ভাস্বর, প্রকাশ উদার ও সামঞ্জস্যপূর্ণ, ইচ্ছাশক্তি সবল অজেয়। কিন্তু তারপরে জগৎ সব অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠল, ক্রমে ক্রমে বহুবিচ্ছিন্ন ও বিশৃঙ্খল হয়ে চলল – কর্মবেগ ধারণ করল রুদ্রমূর্তি, জড়ভূমি হয়ে দাঁড়াল তমোময় সন্তাপময়। তারপর, দুজনে “আমরা” আমাদের অসীম প্রেমের মধ্যে সর্বাঙ্গ দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করলাম অজ্ঞান-অভাবগ্রস্ত পৃথিবীর দারুণ দুঃখ, দেখলাম আমাদের সন্তানেরা ঘোর সংঘর্ষে লিপ্ত, তারা পরস্পরকে আক্রমণ করছে বিপথগামী শক্তিদের দ্বারা চালিত হয়ে; তখন “আমরা” একান্তভাবে আকাঙ্ক্ষা করেছি তোমার দিব্যপ্রেমের আলো যেন প্রকাশ পায় রূপান্তর করবার জন্যে, এই সব উন্মত্ত উপকরণের ঠিক মাঝখানে এসে। ... তখন, ভাগবত ইচ্ছাশক্তি যাতে আরো সবল, আরো সফল হয়ে ওঠে, “আমরা” তোমার দিকে ফিরে দাঁড়ালাম, হে অচিন্ত্য পরাৎপর, যাজ্ঞা করলাম তোমার সহায়। অজ্ঞাতের অতল গভীর থেকে শুনলাম প্রত্যুত্তর এল সমুদাত্ত দুর্নিবার, তখন বুঝলাম ধরিত্রী উদ্ধার পেয়ে গেল ।
২৫ সেপ্টেম্বর ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
হে মধুময়ী জগৎ-জননী! তুমি যদি সঙ্গে থাক, তবে অসম্ভব কি আর? সিদ্ধির দিন সমাগত। তুমি আমাদের নিঃসন্দেহ করেছ যে পরম ইচ্ছাশক্তির সর্বাঙ্গীণ সার্থকতা সাধনে তোমার সহযোগ রয়েছে।
একদিকে অচিন্ত্য সবস্তু, অন্যদিকে আপেক্ষিক প্রপঞ্চ এই উভয়ের মধ্যস্থ করে আমাদের তুমি গ্রহণ করেছ, আমাদের মধ্যে তোমার নিত্য সান্নিধ্যই তোমার শক্তির সক্রিয় সহযোগের প্রমাণ।
ভগবান সংকল্প করলেন, তুমি কর সিদ্ধি তার ।
নূতন এক জ্যোতি পৃথিবীর উপর উদয় হবে।
নূতন এক জগৎ জন্মগ্রহণ করবে।
যা-কিছু প্রতিশ্রুত হয়েছিল, সব তা ফলবেই।
২৮ সেপ্টেম্বর ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
নির্বাক লেখনী, তোমার চির-সান্নিধ্যের স্তুতি করবে বলে। ভগবান, তুমি যেন রাজা, তোমার রাজ্যের পূর্ণ দখল তুমি নিয়ে নিয়েছ। এখন প্রত্যেকটি প্রদেশ তুমি সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে বাড়িয়ে তুলছ; ঘুমন্তকে জাগিয়ে ধরছ, জড়ত্বের দিকে ঝোঁক যাদের তাদের সক্রিয় করে তুলছ, সমস্তকে সুসঙ্গত করে ধরেছ – একদিন আসবে যখন এই সুসঙ্গতি পূর্ণ সিদ্ধ হয়ে উঠবে, তখন সমস্ত সাম্রাজ্যটি তার জীবনধারার ভিতর দিয়ে হয়ে উঠবে তোমার মুখপাত্র, তোমারই আত্মপ্রকাশ।
কিন্তু ইতিমধ্যে, ভগবান, লেখনী নির্বাক তোমার সান্নিধ্যের স্তুতি করবে বলে।
৩০ সেপ্টেম্বর ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
ভগবান, মনের সব জাঙ্গাল তুমি ভেঙে দিয়েছ, উপলব্ধি দেখা দিয়েছে তার পূর্ণ প্রসারে। কোন দৃষ্টিভঙ্গিই ভুললে চলবে না, প্রত্যেকটিকে ধরে তার সিদ্ধিতে সোজা গিয়ে পৌঁছতে হবে, কোনটি বাদ দিয়ে রাখলে হবে না। পথে গতি যাতে বিলম্বিত হয়ে যায় এমন সীমা এমন ছেদ টেনে দিলে চলবে না – তুমি এসে সাক্ষাৎ দাঁড়িয়েছ ঠিক এই কাজেই সাহায্য করবার জন্যে। যারা সব হল তুমি নিজে, যারা প্রকাশ করে তোমাকে – এক একটি বিশেষ ধারায় পূর্ণতা নিয়ে – তারাই আমাদের সহকর্মী । এইতো তোমার ইচ্ছা ।
ভগবতী জননী রয়েছেন আমাদের পাশে, তিনি কথা দিয়েছেন পরাৎপর অখণ্ড চেতনার সঙ্গে – অতল গভীরতা থেকে বাহ্যতম ইন্দ্রিয়জগৎ অবধি সমস্তের সঙ্গে – আমরা থাকব একীভূত হয়ে। আর এ সকল জগতেই অগ্নিদেব তাঁর পাবকশিখা নিয়ে আমাদের সহায় হবেন, বিঘ্ন সব নাশ করে, বীর্য সব সমিদ্ধ করে, সঙ্কল্প সব সঞ্চল করে ধরবেন সিদ্ধি যাতে সত্বর আসে। ইন্দ্রদেব আমাদের সঙ্গে রয়েছেন জ্ঞানের জ্যোতি যাতে পরিপূর্ণতা লাভ করে। আর সোমদেব আমাদের রূপান্তরিত করে ধরেছেন পরম আনন্দের উৎস তাঁর অসীম অদ্বিতীয় অপরূপ প্রেমের মধ্যে।...
ভাগবতী মধুময়ী জননী! বাক্যাতীত সমাহিত প্রীতি নিয়ে অপরিসীম নির্ভর নিয়ে প্রণতি জানাই তোমায়।
ভাস্বর অগ্নিদেব! এত জীবন্ত তুমি আমার অন্তরে! তোমায় আমি আহ্বান করি, আবাহন করি যাতে তুমি আরো জীবন্ত হয়ে ওঠ, যাতে তোমার বেদিকুণ্ড আরো বৃহৎ হয়ে ওঠে, শিখা সব আরো প্রবল, আরো ঊর্ধমুখী হয়ে ওঠে, যাতে সমস্ত সত্তাটি হয় এক জ্বলন্ত দাহন, এক শক্তিপ্রদ হবন ।
ইন্দ্রদেব! তোমায় পূজা করি, তোমায় প্রশস্তি করি, আকুল প্রার্থনা করি যাতে তুমি আমার সঙ্গে এক হয়ে থাক, যাতে মনের সকল বন্ধন তুমি নিঃশেষে দূর করে দাও, দাও আমায় তোমার দিব্যজ্ঞান ৷
হে পরম প্রেম! তোমাকে আমি কখন অন্য নাম দিইনি, তুমিই যে সর্বতোভাবে আমার অন্তরাত্মার সারসত্তা, আমি অনুভব করি তোমাকে, আমার প্রতি ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র অণুর মধ্যে তুমি জাগ্রত স্পন্দিত, যেমন অনন্ত বিশ্বের মধ্যে আর তার বাহিরেও, সকল নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে তুমিই প্রবাহিত, সকল ক্রিয়াকর্মের মধ্যে তুমিই তাদের কেন্দ্র, সকল সদিচ্ছার ভিতরে তুমিই প্রোজ্জ্বল, সকল দুঃখকষ্টের পিছনেও তুমিই রয়েছ প্রচ্ছন্ন, তুমিই আমার ধর্ম, অফুরন্ত তার অনুষ্ঠান, ক্রমেই তা একাগ্র হয়ে চলেছে; আমি যেন উত্তরোত্তর অনুভব করতে পারি যে সত্যসত্যই
৫ অক্টোবর ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
তোমার ধ্যানে, প্রশান্ত নীরবতার মধ্যে, হে সর্বেশ্বর, প্রকৃতি ফিরে আবার নিজেকে শক্ত করে সমর্থ করে তোলে; ব্যক্তিগত মাত্ৰা সব অতিক্রম করে সে ডুবে যায় তোমার আনন্ত্যের মধ্যে যেখানে যাবতীয় ভুবনের এমন ঐক্য-উপলব্ধি যাতে বিশৃঙ্খলা নেই অব্যবস্থা নেই। যে বস্তুর উদ্বর্তন হয়, যার হয় ক্রমবিবর্তন, যা আছে শাশ্বতকালে তাদের সুসঙ্গত সম্মেলন ধীরে গড়ে ওঠে সেখানে, নিরন্তর ক্রম-সমৃদ্ধ ক্রম- প্রসারিত ক্রম-সমুচ্চ সাম্যাবস্থাকে আশ্রয় করে। জীবনের ধারাত্রয় তাদের পরস্পরকে আদানে-প্রদানে তোমার আবির্ভাবকে পূর্ণ করে তোলে।
বহু লোকে তোমাকে আজ খোঁজে – দুঃখকষ্টের, অনিশ্চয়তার ভিতর দিয়ে। তাদের কাছে আমি যেন হয়ে উঠতে পারি তোমার প্রতিভূ, যাতে তোমার আলো তাদের আলোকিত করে, তোমার শান্তি তাদের
প্রশান্ত করে ধরে । ...
এ-সত্তাটি এখন শুধু তোমার কর্মের একটি অবলম্বন, তোমার চেতনার একটি কেন্দ্র।
কোথায় গেল সব সীমা বাধা! তোমার রাজ্যের তুমিই একচ্ছত্র রাজা।
৭ অক্টোবর ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
আলো যেন ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর উপর, শান্তি যেন বিরাজ করে সকল হৃদয়ে! ...প্রায় সকলে জানে কেবল সেই জীবন যা স্থূল জড় ভারগ্রস্ত, পরিবর্তন-বিমুখ, তামসিক; তাদের প্রাণশক্তিও জীবনের এই বাহ্যরূপে এত আসক্ত যে দেহের বাহিরে নিজের ধারায় মুক্তি পেলেও সে ব্যাপৃত থাকে কেবল দুঃখকষ্টে ভরা দৈনন্দিন স্থূল নৈমিত্তিক ব্যাপার নিয়ে। আর যাদের মধ্যে মানসিক জীবন জাগ্রত হয়েছে তারা হল দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, বিক্ষুব্ধ, স্বেচ্ছাচারী, প্রভুত্বপ্রয়াসী; যেসব পরিবর্তনের পুনঃসংস্কারের স্বপ্ন তারা দেখে তার ঘূর্ণিপাকের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে তারা ব্যস্ত কেবল ধ্বংস করবার জন্যে, কি-বস্তুর উপর দাঁড়িয়ে যে গড়তে হবে আদৌ তা না জেনে – তাই তাদের আলো হল যেন চোখ ধাঁধান বিজলীচমক, বিশৃঙ্খলা তাতে বেড়েই যায়, দূর হয় না। তোমার ধ্যানে রয়েছে যে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি, তোমার অক্ষয় আনন্ত্যের যে স্থির দৃষ্টি, তারই অভাব সকলের মধ্যে।
এই ব্যষ্টিসত্তাটির উপর তোমার পরম করুণা, অসীম কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাই সে প্রার্থনা করে, হে ভগবান, যেন ঠিক এই বর্তমানের আলোড়নকে আশ্রয় করে, এই অপরিসীম বিশৃঙ্খলার ভিতরই ঘটে অত্যাশ্চর্য ঘটনা – যেন তোমার পরম প্রশান্তির তোমার নিরবচ্ছিন্ন বিশুদ্ধ জ্যোতির বিধান সকলের প্রত্যক্ষ হয়, তারই শাসন মেনে চলে যেন তোমার চেতনায় নব-জাগ্রত মানুষের পার্থিব প্রকৃতি।
মধুময় হে ভগবান! প্রার্থনা তুমি শুনেছ, এই আহ্বানে সাড়াও তুমিদেবে।
১৪ অক্টোবর ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
ভগবতী মা! তুমি আমাদের সঙ্গে রয়েছ, প্রতিদিন তার প্রমাণ তুমি আমায় দিয়ে চলেছ। আর তোমার সঙ্গে ক্রমে আরো সমগ্রভাবে, আরো নিরবচ্ছিন্নভাবে, অন্তরঙ্গ একাত্মতায় একীভূত হয়ে “আমরা” ফিরেছি বিশ্ববিধাতার দিকে এবং সেই বস্তুর দিকে যা তাঁকেও ছাড়িয়ে রয়েছে, নবতর জ্যোতির উদ্দেশ্যে বিপুল আস্পৃহা নিয়ে। সমস্ত পৃথিবী আমার কোলে, পীড়িত শিশু যেন, তাকে নিরাময় করতে হবে, দুর্বল বলেই তার উপর পড়েছে বিশেষ স্নেহ। শাশ্বত সম্ভূতির বিপুলতায় হিন্দোলিত হয়ে – এই কারণে যে এ সব সম্ভূতিই হলাম আমরা নিজে – অব্যয় নীরবতার আনন্ত্যকে আমরা ধ্যান করি নীরবে সানন্দে, সেখানে পূর্ণচেতনার মধ্যে, অক্ষয় সত্তার মধ্যে সবই সংসিদ্ধ, অপরূপ সে তোরণ উন্মুক্ত ওপারে যে অজ্ঞাত তার দিকে।…
আবরণ ছিন্ন হয়ে যায়, অবর্ণনীয় মহিমা উদ্ঘাটিত হয়, আমরা অনির্বচনীয় আলোকচ্ছটায় আপ্লুত হয়ে ফিরে আসি জগতের দিকে, তার জন্যে শুভবার্তা নিয়ে আসি। ...
ভগবান, তুমি আমাকে অসীম সুখ দিয়েছ কোন্ মানুষ কোন্ ঘটনা আমার কাছ থেকে তা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে?
২৫ অক্টোবর ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
তোমাকে চেয়ে, ভগবান, আমার আস্পৃহা গ্রহণ করেছে একটি সুন্দর গোলাপের রূপ – তেমনি সুসঙ্গত, পূর্ণ প্রস্ফুটিত, সুরভিত। দুহাতে ধরে তাকে আমি তোমায় উৎসর্গ করি, প্রার্থনা করি তোমার কাছে – আমার বুদ্ধি যদি সীমাবদ্ধ হয় তাকে প্রসারিত কর; আমার জ্ঞান যদি হয় তমসাচ্ছন্ন, তাকে আলোকিত কর; আমার হৃদয় যদি হয় উৎসাহহীন, তাকে প্রজ্বলিত কর; আমার প্রেম হয় যদি স্তিমিত, তাকে তীব্র করে ধর; আমার অনুভব যদি হয় অচেতন অহংকারী, সত্যের মধ্যে তাকে পূর্ণ জাগ্রত কর। আর এই যে “আমি” প্রার্থনা করে এ-ভাবে, ভগবান, তা তো সহস্র ব্যষ্টির মধ্যে হারিয়ে যাওয়া কোন ক্ষুদ্র ব্যক্তিবিশেষ নয়, তা হল সারা পৃথিবী, তার আস্পৃহা তোমার দিকে পূর্ণ আগ্রহে সবেগে
চলেছে।
ধ্যানের পরিপূর্ণ নীরবতায় সব জিনিসই প্রসারিত হয়ে চলেছে অনন্ত অবধি; নীরবতার পরিপূর্ণ শান্তির মধ্যে তুমি আবির্ভূত তোমার জ্যোতির প্রোজ্জ্বল মহিমা নিয়ে ।
৮ নভেম্বর ১৯১৪
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
পূর্ণ আলোকের জন্যে তোমাকে আবাহন করি, ভগবান – আমাদের মধ্যে প্রকাশের শক্তি জাগিয়ে ধর।...
আধারের মধ্যে সব মূক, রয়েছে যেন নির্জন গুহাভ্যন্তরে। কিন্তু নীরবতা আর আঁধারের গর্ভেই তো জ্বলছে অনির্বাণ প্রদীপ, তীব্র অভীপ্সার আগুন – সর্বাঙ্গে তোমাকে জানবার জন্যে, তোমারই জীবন যাপন
করবার জন্যে ।
রাত্রির পর দিন আসে, আসে ঊষার পর ঊষা অবিশ্রান্ত; কিন্তু নিরন্তর উঠে চলে সুরভিত অগ্নিশিখা, কোন ঝড়ের দাপট তাকে বিচলিত করে না – উঠে চলে আরো ঊর্ধ্বে, আরো; একদিন ঠেকবে গিয়ে উপরের আবরণে মিলনের সর্বশেষ বাধায়। কিন্তু আগুনের শিখা এত বিশুদ্ধ এত ঋজু এত সমুন্নত যে বাধা অকস্মাৎ চলে যায়…
তখন তুমি আবির্ভূত হলে তোমার পরিপূর্ণ জ্যোতির্ময় মূর্তি নিয়ে, তোমার অসীম মহিমার প্রখর ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে। তোমার স্পর্শে আগুনের শিখা রূপান্তরিত হয় আলোকের স্তম্ভে, আঁধার সব দূর হয় চিরতরে।
মহামন্ত্র উৎসারিত হয়েছে, পূর্ণকে প্রকট করেছে!
বছর: ১৯১৫
১৫ ফেব্রুয়ারী ১৯১৫
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
সত্যরূপী ভগবান! বারবার তিন বার আমি তোমায় ডেকেছি – বিপুল ব্যাকুলতা নিয়ে, তোমার প্রকাশের জন্যে মিনতি করে ।
তারপর সমগ্র সত্তা তার অভ্যাসমত তোমার কাছে নিজেকে পূর্ণ সমর্পণ করে দিল। তখন দেখতে পেল তার ব্যষ্টিগত মনোময় প্রাণময় অন্নময় সত্তা ধূলায় যেন আবৃত হয়ে আছে; তাই তোমার সম্মুখে আপ্রণত হয়ে, মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে, মাটির জিনিস মাটিতে রেখে বললে: “ভগবান, ধূলিগঠিত এই আধার তোমার কাছে আপ্রণত, তার প্রার্থনা সে যেন সত্যের আগুনে প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে, তোমাকে ছাড়া আর কিছু যেন প্রকাশ না করে।” তুমি তখন তাকে বললে: “উঠে দাঁড়াও, সকল ধূলি হতে মুক্ত শুদ্ধ তুমি।” চক্ষের নিমেষে হঠাৎ সকল ধূলি ঝরে গেল মাটিতে, গায়ের বস্ত্র খসে পড়ে যেমন – আধার দেখা দিল সমুন্নত, তবু তেমন বস্তুময় অথচ প্রখর জ্যোতির্ময়।
৩ মার্চ ১৯১৫
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
“কামো মারু” জাহাজে :
কঠোর নিঃসঙ্গতা... আর নিরন্তর তীব্র অনুভব যেন একটা অন্ধকারের নরকের মধ্যে আমাকে সোজা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। জীবনে আর কোন মুহূর্তে, কোন অবস্থাতেই কখনও বোধহয় এমন আবেষ্টনের মধ্যে বাস আমি করিনি – আমার চেতনায় সত্য বলে জেনেছি যা-কিছু আমার জীবনের সারভূত যা-কিছু তাদের এত সম্পূর্ণ বিপরীত। সময়ে- সময়ে সে-অনুভব, সে-বৈপরীত্য এত গাঢ় হয়ে ওঠে যে আমার অখণ্ড সমর্পণের মধ্যে একটা বিষাদের ছায়াপাত আমি বন্ধ করতে পারি না, আর এও নিবারণ করতে পারি না যে অন্তর্যামী প্রভুর সঙ্গে প্রশান্ত নীরব আলাপ মুহূর্তের জন্যে একটা প্রায় সানুযোগ আবাহনে পরিণত হয়ে যায়: “ভগবান, আমি কি করেছি যার জন্যে এমন আঁধার রাত্রির মধ্যে আমাকে ফেলে দিয়েছ?” কিন্তু তখনি আবার আস্পৃহা খরতর হয়ে ওঠে: “সকল স্খলন থেকে এ-আধারটিকে রক্ষা কর, ভগবান। তোমার কর্মের জন্যে – যাই হোক না তা সে যেন হয়ে ওঠে অনুগত দৃষ্টিময় যন্ত্ৰ। ”
বর্তমানে সে-দৃষ্টি নেই – ভবিষ্যৎ এরকম আবৃত হয়ে আর কখন ছিল না। মনে হয় চলেছি যেন একটা সমুচ্চ অভেদ্য দেওয়ালের দিকে – ব্যক্তির ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত যা-কিছু সে-সম্বন্ধে। জাতি ও দেশের ভবিষ্যৎ তুলনায় পরিষ্কার দেখা যায় বটে, কিন্তু এসব বিষয়ে কিছু বলা নিরর্থক আগামী কালই তাকে সকলের চোখের সামনে, এমনকি একেবারে অন্ধেরও সম্মুখে এনে ব্যক্ত করে ধরবে।
৭ মার্চ ১৯১৫
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
মনের মধুর নীরবতার দিন চলে গিয়েছে – কি শান্তিপূর্ণ, কি নির্মল দিন সব! তার ভিতরে অনুভব হত এমন গভীর এষণা যা তার সত্যের সমস্ত শক্তি নিয়ে আপনাকে প্রকাশ করত। কিন্তু এখন সে-এষণা আর দেখা দেয় না, কাজেই মন আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে – বিশ্লেষণ করে, সুশৃঙ্খলিত করে, বিচার করে, গ্রহণবর্জন করে, আর যা-কিছু এই প্রসারিত ব্যক্তিত্বটির উপর এসে পড়ে তাদের উপর তার প্রতিক্রিয়া চলেছে নিরন্তর, রূপান্তর সাধনের জন্যে; সে-ব্যক্তিত্ব এত প্রসারিত যে এখন তার সংযোগ হয়েছে অতি বিপুল, জটিল পৃথিবীর সব বস্তু যেমন তেমন আলো-আধাঁরে মিশ্রিত জগতের সঙ্গে এ যেন সব আধ্যাত্মিক সুখ-স্বস্তি থেকে নির্বাসন; আর তোমার সব পরীক্ষার মধ্যে, ভগবান, এইটিই হল নিঃসন্দেহে সব চেয়ে ক্লেশকর। বিশেষভাবে, তোমার ইচ্ছাশক্তির প্রত্যাহার মনে হয় যেন তোমার পূর্ণ বিরাগের পরিচয়। প্রত্যাখ্যানের বোধ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। তাই এখন বাহ্যচেতনা এই যে নিঃসঙ্গ পড়ে আছে, তাকে বেদনা এসে যাতে চিরকালের জন্যে অভিভূত না করে বসে, সেজন্য দরকার হয়েছে অশ্রান্ত বিশ্বাসের পূর্ণ উৎসাহ।...
কিন্তু হতাশ হতে চায় না সে, বিশ্বাস করে না এমন দুর্ভাগ্য কিছু হতে পারে যার প্রতিকার নেই – আনত হয়ে সে অপেক্ষা করে, অলক্ষ্যে গোপনে প্রযত্ন করে লড়াই করে চলেছে, আবার যাতে তোমার অখণ্ড আনন্দের প্রশ্বাস তার মধ্যে প্রবেশ করে, তাকে পরিপূর্ণ করে ধরে। হয়তো-বা তার প্রতিটি সামান্য প্রচ্ছন্ন বিজয়ই পৃথিবীর পক্ষে সত্যকার সহায় হয়েছে।...
বাহ্যচেতনা থেকে যদি নিষ্ক্রান্ত হওয়া যেত চিরকালের জন্যে, যদি দিব্যচেতনার মধ্যে আশ্রয়-গ্রহণ করা যেত.... কিন্তু তা তুমি আমায় বারণ করেছ, সর্বদাই বারণ করছ। জগৎ থেকে পলায়ন নয় – মলিনতার, কদর্যতার ভার শেষ অবধি বহন করে চলতে হবে – ভগবানের সহায় থেকে বঞ্চিত মনে হলেও দৃপাত না করে। রাত্রির কোলের মধ্যে থাকতে হবে, চলতে হবে, দিক্-যন্ত্র বিনা, আলো বিনা, আন্তর দিশারী বিনা ।…
তোমার করুণা পর্যন্ত আমি ভিক্ষা করতে চাই না – কারণ, তুমি যা
চাও আমার জন্যে, আমিও তাই চাই। আমার সমস্ত কর্মবলের একমাত্র প্রেরণা হল এগিয়ে চলা, নিরন্তর এগিয়ে চলা, এক পায়ের পর আর-এক পা করে – পথের আঁধার যতই গাঢ় হোক, আর বাধাও যতই থাকুক।
যাই ঘটুক না, ভগবান, তোমার নির্দেশ আমি বরণ করে নেব, ঐকান্তিক চিরস্থির প্রেমভরে। আর যদিও-বা তুমি যন্ত্রটিকে অনুপযুক্ত বলে দেখে থাক, যন্ত্র তো আর তার নিজের নয়, সে তোমারই। .....তুমি তাকে নষ্ট করতে পার বা সমৃদ্ধ করতে পার, কিন্তু সে তো আর তার নিজের জন্যে নেই, সে কিছু চায় না এবং পারেও না তুমি না থাকলে। ....
৮ মার্চ ১৯১৫
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
মোটের উপর, একটা প্রশান্ত, গভীর উদাসীনতার অবস্থা এখন – আধারের মধ্যে কোন অনুভব নেই, বাসনার বা বিরাগের, উৎসাহের বা অবসাদের, সুখের বা দুঃখের। জীবনকে সে দেখেছে একটা দৃশ্যাবলীর মত, সেখানে তার স্থান অতি অকিঞ্চিৎকর। সে দেখছে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, শক্তি সকলের সংঘর্ষ সব একদিকে হল আধারেরই অঙ্গ – সে-আধার তার সাময়িক ক্ষুদ্র-ব্যক্তিত্বকে চারদিক দিয়ে ছাড়িয়ে ছাপিয়ে গিয়েছে – অন্যদিকে, তারা আবার এই ব্যক্তিত্ব থেকে সম্পূর্ণ বিভিন্ন ৷
তবে সময়ে-সময়ে একটা বিপুল হাওয়া বয়ে যায়; বেদনার, মর্মন্তুদ নিঃসঙ্গতার, আধ্যাত্মিক দৈন্যের হাওয়া – ভগবৎ-পরিত্যক্ত পৃথিবীর যেন আকুল আহ্বান। ...এ বেদনা নিষ্করুণ যত ততটাই নীরব, আনত অবিদ্রোহী – সে বেদনার মধ্যে কোন ইচ্ছাই নেই তাকে এড়িয়ে যেতে বা তা থেকে বের হয়ে যেতে, তার মধ্যে রয়েছে একটা অসীম মাধুর্য, যাতে নিবিড়ভাবে মিশে আছে দুঃখ আর আনন্দ, এমন একটা জিনিস, অসীম তার প্রসার, মহান, গভীর; বোধ হয় এত মহান্, এত গভীর যে মানুষের ধারণার অতীত তা... এমন এক জিনিস যার গর্ভে রয়েছে ভবিষ্যতের বীজ।...
২৬ নভেম্বর ১৯১৫
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
চেতনা সম্পূর্ণ ডুবে ছিল ভগবানের ধ্যানে, সমগ্র আধার ছিল এক বৃহৎ, এক পরম মহাসুখ-ভোগে ৷
স্থূল দেহ, প্রথমে তার নিম্নতর অঙ্গগুলি, পরে সমগ্রভাবে, একটা পুণ্য স্পন্দনে শিহরিত; ক্রমে জড়তম অনুভবেরও সকল ব্যক্তিগত সীমানা খসে পড়ল। সত্তা বৃহৎ হতে বৃহত্তর হয়ে উঠল, ধাপে ধাপে, সুনিয়মিতভাবে, সকল জাঙাল ভেঙ্গে দিয়ে, সকল বাধা কাটিয়ে, যাতে সে ধারণ করতে পারে, প্রকাশ করতে পারে, প্রসারে তীব্রতায় নিরন্তর বর্ধমান এক মহা বল, এক মহা শক্তি। এ যেন দেহের যাবতীয় কোষ ক্রমে স্ফীত হয়ে চলেছে, শেষে সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে গিয়েছে। আকাশের প্রসারে সুসমঞ্জসভাবে এই যে পৃথিবীমণ্ডল ঘুরে চলেছে, জাগ্রত চেতনার দেহ যেন তাই হয়ে উঠেছে – তবে চেতনা জানে তার পার্থিব-মণ্ডলাকার দেহ এ রকমে চলেছে বটে, কিন্তু বিশ্ব-পুরুষের আলিঙ্গন-বদ্ধ হয়ে তারই কাছে নিজেকে দিয়ে দিয়েছে, ছেড়ে দিয়েছে প্রশান্ত আনন্দে বিভোর হয়ে। তখন চেতনার অনুভব হল, তার দেহ বিশ্বের দেহের সঙ্গে মিশে গিয়েছে; চেতনা তাই হয়ে উঠেছে বিশ্বের চেতনা, তার নিশ্চল সমগ্রতা নিয়ে আবার তার আপনার অন্তর্গত সচল সব অনন্ত-বৈচিত্র্য নিয়ে । বিশ্বের চেতনা আবার ছুটল ভগবানের দিকে, তীব্র আস্পৃহা আর পূর্ণ সমৰ্পণ নিয়ে – দেখল সে নিষ্কলঙ্ক জ্যোতির প্রভামণ্ডলে প্রজ্বলন্ত পুরুষ বহুশীর্ষ এক সর্পের উপর দাঁড়িয়ে, সর্পটির দেহ পৃথিবীকে জড়িয়ে ধরেছে অনন্তভাবে। আর সে-পুরুষ তাঁর সনাতনী বিজয়-ভঙ্গিতে সৰ্পটিকে এবং সর্প হতে নিঃসৃত বিশ্বকে যুগপৎ দমনে রেখেছেন এবং সৃষ্টি করছেন। সমগ্র বিজয়ী শক্তি নিয়েই তিনি সর্পটির উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন – সে অঙ্গভঙ্গি বিশ্বগ্রাসী সর্পটিকে প্রতিহত করে রেখেছে যেমন, আবার তেমনি নিরন্তর পুনর্জীবিত করে চলেছে। চেতনা তখন সেই পুরুষই হয়ে উঠল, দেখল তার রূপ আবার বদলে গেল, মিলে মিশে গেল এমন একটা জিনিসের মধ্যে যার নিজের রূপ নেই, যাতে
বছর: ১৯১৬
২৬ ডিসেম্বর ১৯১৬
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
নীরবতার মধ্যে যে-কথা আমায় শুনাও, ভগবান, সর্বদাই তা মধুর, ভরসাপূর্ণ। কিন্তু আমি তো দেখতে পাই না, এই যে যন্ত্রটির উপর এত করুণা তুমি বর্ষণ কর, তার যোগ্য সে কি রকমে, কি রকমেই-বা তুমি যা আশা কর তার কাছে তা পূর্ণ করবার ক্ষমতা তার হবে। এ দারুণ গুরুভার ভূমিকা বহন করবার সামর্থ্য রাখতে হলে তার যা হওয়া দরকার সে-তুলনায় সবই তো তার মধ্যে দেখা যায় এত ক্ষুদ্র, এত দুর্বল, এত অতি-সাধারণ – না আছে বল, না আছে বীর্য, না আছে প্রসার। কিন্তু আমি জানি মন যা ভাবে তার মূল্য খুবই সামান্য, নিজেই সে একথা জানে, তাই সে আপনাকে ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা করছে তোমার আদেশের ক্রমপ্রকাশ।
তুমি আমাকে বলছ সদাসর্বদা যুদ্ধ করে চলতে আমি চাই আমার যেন থাকে সেই অদম্য উৎসাহ যার কল্যাণে সকল বাধাবিপত্তি পার হওয়া যায়। কিন্তু আমার হৃদয়ের মধ্যে তুমি ভরে দিয়েছ এমন প্ৰসন্ন প্রশান্তি যে আশঙ্কা হয় যুদ্ধ করা যেন আমার পক্ষে সম্ভবই হবে না… সব জিনিস, বৃত্তি হোক আর কর্ম হোক, আমার মধ্যে ফুটে ওঠে, ফুল যেমন ফুটে ওঠে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে, বিনা আয়াসে; শুধু আছে, বেড়ে উঠছে, তারই আনন্দে, তোমাকে প্রকাশ করে ধরবার আনন্দে, প্রকাশের ধারা যাই হোক না। আর এই যুদ্ধ যদিই-বা থাকে, তবে তা এত সহজ এত সরল যে তাকে ও-নাম দেওয়াই যায় না। কিন্তু এতখানি প্রেম ধারণ করবার পক্ষে কি ক্ষুদ্রই না এ হৃদয়! আর তাকে পরিবেশন করে ধরবার পক্ষে এই প্রাণ এই দেহ কি না দুর্বল! তুমি আমাকে সেই অপরূপ পথখানির পাশে এনে দাঁড় করিয়েছ, আমার পায়ের সামর্থ্য হবে কি তাতে উঠে চলবার? ...তোমার উত্তর হল, আমাকে উড়ে চলতে হবে, পায়ে হেঁটে চলবার চেষ্টা করলে ভুল হবে... ভগবান, অসীম তোমার করুণা! আর একবার তোমার সর্বশক্তিমান বাহুর মধ্যে তুমি আমাকে তুলে নিলে, তোমার অতল হৃদয়ের মধ্যে ধরে আমায় আদর করলে – সে হৃদয় আমায় বললে: “কোন চিন্তা করো না, শিশুর মত নির্ভর করে থাক – তুমি কি আমিই নও, আমার কাজের জন্যে আমারই সংহতরূপ?...”
২৭ ডিসেম্বর ১৯১৬
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
হে পরম-প্রিয় ভগবান আমার, এ হৃদয় তোমার কাছে অবনত, এই বাহুদুটি তোমার দিকে প্রসারিত, তোমাকে মিনতি করে, তোমার দিব্যপ্রেমের স্পর্শে এই সত্তাকে সমগ্রভাবে প্রজ্বলিত করে তোল, যাতে জগতের উপর তার আলো ছড়িয়ে পড়ে। আমার বুকের মধ্যে আমার হৃদয়খানি পূর্ণ উন্মুক্ত তোমার দিকে, ফিরে রয়েছে তোমার দিকে; সে উন্মুক্ত ও শূন্য যাতে তুমি তা ভরে দিতে পার তোমার দিব্যপ্রেম দিয়ে – সে শূন্য, সেখানে কিছুই নেই তুমি ছাড়া, তোমার অস্তিত্ব দিয়ে তাকে ভরে রেখেছ, তবুও সে শূন্য; কারণ তা ধারণ করতে পারে ব্যক্ত সৃষ্টির অনন্ত বৈচিত্র্য যা-কিছু সবই।
ভগবান, এই বাহুদুটি তোমার দিকে প্রসারিত হয়ে তোমাকে মিনতি করছে, এ হৃদয় তোমার দিকে পূর্ণরূপে নিজেকে খুলে ধরেছে যাতে সে হয়ে উঠতে পারে তোমার অসীম প্রেমের ভাণ্ডার।
“সকল জিনিসের মধ্যে সকল জীবের মধ্যে সর্বত্র আমাকে ভালবাস” – এই তোমার উত্তর। তোমার চরণে আলুণ্ঠিত হয়ে তোমাকে মিনতি করি, আমাকে তুমি দাও সে-শক্তি…
বছর: ১৯১৭
৩০ মার্চ ১৯১৭
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
নিজেকে নিয়ে আদৌ ব্যস্ত না থাকার মধ্যে আছে একটা সমুচ্চ রাজশ্রী। অভাব থাকা অর্থ দুর্বলতা জ্ঞাপন; কোন জিনিস আকাঙ্ক্ষা করা প্রমাণ করে তুমি সে জিনিস থেকে বঞ্চিত। কামনা করা অর্থ অশক্ত হওয়া, নিজের সীমা স্বীকার করা, স্বীকার করা সেসব সীমা অতিক্রম করা অসাধ্য ৷
অন্য কোন দিক থেকে নয়, দেখা যায় যদি কেবল ন্যায়সঙ্গত আত্মমর্যাদা, তা হলে আন্তর আভিজাত্যের জন্যেই সকল বাসনা পরিত্যাগ করা উচিত। নিজের জন্যে জীবনের কাছে, আর যে পরাচেতনা তাকে অনুপ্রাণিত করে তার কাছে কিছু যাজ্ঞা করা কতখানি না আত্ম-অবমাননা – কত-খানি আত্ম-অবমাননা তা আপনার কাছে, কতখানি অপমানকর অজ্ঞতা সেই পরাচেতনার কাছে। কারণ, সবই তো আমাদের আয়ত্তের মধ্যে – কেবল, আমাদের সত্তার অহং-নির্মিত সীমাবন্ধ আমাদের বঞ্চিত করে রেখেছে সারা বিশ্বের ঠিক সেই পূর্ণ বাস্তব উপভোগ থেকে, যে পূর্ণ বাস্তব উপভোগ রয়েছে আমাদের নিজেদের দেহের এবং সন্নিহিত পরিবেশের
ক্ষেত্রে।
আর কর্মের উপায় সম্বন্ধেও আমাদের মনোভাব হওয়া উচিত এই ধরনের।
তুমি আমার হৃদয়ের মধ্যে অবস্থান কর, তোমার পরম ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সব চালনা কর; তুমি আমায় বলেছ, এক বছর পূর্বে, সব বন্ধন কেটে ফেলে দিতে, মাথা এগিয়ে সোজা ঝাঁপিয়ে পড়তে অজ্ঞাতের মধ্যে, সীজর যেমন করেছিলেন যখন তিনি রুবিকন নদী পার হলেন এই মন্ত্ৰ নিয়ে – হয় “কপিটল”-চূড়া নতুবা “তারপাই” পাহাড়ের তলা ৷
আমার চোখ তুমি বন্ধ করে দিলে যাতে কর্মের ফল আমি না দেখতে পাই। তাকে এখনো তুমি গুপ্ত রেখেছ; তবুও তুমি তো জান, ঐশ্বর্য হোক আর দৈন্য হোক, দুয়েরই সম্মুখে একই আমার অন্তরাত্মার সমতা।
তোমার ইচ্ছা, ভবিষ্যৎ আমার কাছে থাক অনিশ্চিত, আমি যেন দৃঢ় বিশ্বাসে এগিয়ে চলি, পথ কোন্ দিকে নিয়ে চলেছে তা না জেনেও ।
তোমার ইচ্ছা, আমি যেন আমার ভাগ্য সম্বন্ধে চিন্তাভার সম্পূর্ণরূপে তোমার উপর অর্পণ করি, ব্যক্তিগত সকল ভাবনা যেন সমগ্রভাবে বিসর্জন দিতে পারি ।
আমার নিজের মনের কাছেও আমার পথ থাকবে নিঃসন্দেহে অজ্ঞাত অভিনব ।
৩১ মার্চ ১৯১৭
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
তোমার দিব্য প্রশ্বাসে কোথাও কোন হৃদয় যখন দুলে ওঠে, যেন মনে হয় আরো একটু সৌন্দর্য পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করল, আকাশ বাতাস যেন মধুর সুগন্ধে সুরভিত হয়ে উঠল, সকলি যেন আরো আপনজন হয়ে উঠল।
কি শক্তি না তোমার, হে সর্বলোকেশ্বর! তোমার আনন্দের একটি কণিকামাত্র এতখানি অন্ধকার এতখানি বেদনা মুছে ফেলতে পারে, তোমার মহিমার একটি রশ্মি একান্ত অসাড় যে পাথরখানি, একান্ত তমোগ্ৰস্ত যে চেতনা তাকেও উদ্ভাসিত করে ধরতে পারে ।
তুমি তোমার এত অনুগ্রহ সব ঢেলে দিয়ে আমায় অভিভূত করেছ, কত রকম গুপ্তরহস্যই না আমার কাছে ব্যক্ত করেছ, কত অপ্রত্যাশিত অনপেক্ষিত আনন্দ উপভোগ করতে দিয়েছ – কিন্তু যখন তোমার দিব্য প্রশ্বাসে কোথাও কোন হৃদয় দুলে ওঠে, তখন তুমি যে কৃপা আমাকে দেখাও, তার তুলনা তোমার আর কোন করুণাই নয়।…
ধন্য সেসব মুহূর্ত, তখন সমস্ত পৃথিবী আনন্দের স্তুতি গেয়ে ওঠে, পুলকে তৃণশস্প রোমাঞ্চিত, বাতাস আলোর তরঙ্গে স্পন্দিত – তরু সব আকাশের দিকে প্রসারিত করে দেয় তাদের তীব্রতম প্রার্থনা, পাখীর গান হয়ে ওঠে কীর্তন, সাগরের ঢেউ সব প্রেমে স্ফীত হয়ে ওঠে, শিশুর মুখে হাসি অনন্তের কাহিনী বলে, মানুষের অন্তরাত্মা তার চোখের পাতায় ভেসে ওঠে।
বল ভগবান, তুমি কি সে অপূর্ব শক্তি আমাকে দেবে না, যাতে উৎসুক হৃদয়ে আমি এই নব ঊষার জন্মদান করতে পারি, যাতে সকলের চেতনা তোমার সান্নিধ্যে সজাগ হয়ে উঠতে পারে, যাতে এমন দুঃখী এমন বিপর্যস্ত জগতেও তোমার সত্যকার স্বর্গের একটুখানি ফুটিয়ে তুলতে পারি? কোন্ পার্থিব সুখ, সম্পদ, শক্তি এই পরমদানের সমতুল?...
ভগবান, তোমার কাছে কখন বৃথা প্রার্থনা করিনি; কারণ আমার মধ্যে যে তুমি, সে-ই তো কথা বলছে তোমারই সঙ্গে…
বিন্দু বিন্দু করে জীবন্ত ধারায় তুমি ঢেলে দিয়েছ তোমার সর্বশক্তিময় প্রেমের প্রাণদায়ী উদ্ধারক অগ্নিশিখা। আমাদের অজ্ঞান অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতের উপর চিরন্তন জ্যোতির বিন্দুধারা ধীরে ধীরে পড়তে থাকে যখন, তখন মনে হয় নিরালোক আকাশ থেকে পৃথিবীতে বর্ষিত হয় সোনার নক্ষত্র সব একে একে।
আর এই অলৌকিক ঘটনা ঘটছে নিত্যনূতন হয়ে – তার সম্মুখে সকলে নির্বাক ভক্তিভরে আভূমি প্রণত।
৭ এপ্রিল ১৯১৭
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
একটা বিপুল একাগ্রতা আমাকে অধিকার করল, আমি দেখতে পেলাম একটি চেরীফুলের সঙ্গে আমি একাত্ম হয়ে গিয়েছি। তারপর এই ফুলটির ভিতর দিয়ে যাবতীয় চেরীফুলের সঙ্গে মিলিত হয়ে গেলাম। তারপর চেতনার আরো গভীরে নেমে গিয়ে, একটা নীলাভ শক্তির স্রোতে চলে, আমি হয়ে উঠলাম একেবারে চেরীগাছটিই, আকাশের দিকে আমার বাহুরই মত শাখা সব পুষ্পার্ঘ্যভার নিয়ে প্রসারিত। ঠিক সেই সময়ে
আমি স্পষ্ট এই কথাগুলি শুনতে পেলাম:
“তুমি চেরীগাছের আত্মার সঙ্গে নিজেকে এক করে দিয়েছ, তাই তুমি আবিষ্কার করতে পেরেছ যে ভগবান নিজেই ঊর্ধ্বে আকাশের দিকে চেয়ে ফুলদের এই প্রার্থনার অর্ঘ্যদান করছেন।”
কথাগুলি শুনি যখন তখনি লিখে রাখলাম, পর মুহূর্তে সব মুছে গেল এখন কিন্তু চেরীর রক্ত আমার ধমনীতে বয়ে চলেছে, আর সেই সঙ্গে রয়েছে একটা অতুলন শক্তি ও শান্তি। মানুষের দেহ আর গাছের দেহে কি প্রভেদ? কোনই প্রভেদ নেই বস্তুত – যে চেতনা উভয়কে অনুপ্রাণিত করে তা এক অভিন্ন ।
তখন চেরীগাছটি আমার কানে কানে বললে –
“চেরীগাছের ফুল হল ‘বাসন্তী’-রোগের ওষুধ।”
২৮ এপ্রিল ১৯১৭
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
হে আমার অধীশ্বর ভগবান আজ সন্ধ্যায় তুমি আমায় দেখা দিয়েছিলে তোমার সমস্ত জ্যোতির্ময় ঐশ্বর্য নিয়ে। তুমি তো এক মুহূর্তে এই সত্তাটিকে সম্পূর্ণ শুদ্ধ, আলোকিত, স্বচ্ছ, সচেতন করে তুলতে পার; তার অজ্ঞানান্ধকারের অবশিষ্ট চিহ্নগুলি থেকে, তার সর্বশেষ আকর্ষণ থেকে তাকে মুক্ত করে দিতে পার... কিন্তু তুমি কি তা করনি, যখন আজ সন্ধ্যাতেই তুমি তাকে অভিসিঞ্চিত করে দিলে তোমার দিব্যপ্রভাব, তোমার অবর্ণনীয় দীপ্তি দিয়ে? হয়তো... কারণ আমার মধ্যে রয়েছে এক অমানুষী শক্তি, তা শান্তি দিয়ে বিশালতা দিয়ে গড়া। তোমার কাছে শুধু প্রার্থনা, এই শিখর হতে যেন কখনও আমি বিচ্যুত না হই, সদাসর্বদা যেন তোমার শান্তি সর্বেশ্বর হয়ে আমার মধ্যে বিরাজ করে – শুধু গভীরের স্তরে নয়, সেখানে তো বহু দিন থেকেই সে অধীশ্বর হয়েছে, কিন্তু বাহিরের ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র কর্মেরও মধ্যে, হৃদয়ের এবং বৃত্তির ক্ষুদ্রাদপি
ক্ষুদ্র অন্তরালের মধ্যেও ৷
ভগবান, সকল জীবের মুক্তিদাতা! প্রণাম করি তোমায় !
“ধর, এই যত ফুল, এই যত আশিষ; এই যত ভাগবত প্রেমের হাসি, তার না আছে পক্ষপাত, না আছে বিরাগ... সকলের দিকে, উদার প্রবাহে বয়ে চলেছে, তার অনুপম দান সব সে ফিরে প্রতিগ্রহণ করে না কখনও।”
পরমানন্দের ভঙ্গিমায় তাঁর বাহুদুটি প্রসারিত করে দিয়ে, চিরন্তনী মাতা জগতের উপর বর্ষণ করেছেন তাঁর বিশুদ্ধতম প্রেমের অবিরল শিশিরধারা । ....
২৪ সেপ্টেম্বর ১৯১৭
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
টোকিও :
একটা কঠোর নিয়মপালন তুমি আমাকে দিয়ে করিয়েছ – ধাপের পর ধাপ আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়েছি, পৌঁছেছি তোমার কাছে, আর এই ঊর্ধ্বায়নের চূড়ায় আমায় দিলে একাত্মতার অনন্ত আনন্দ-সম্ভোগ। তারপর তোমার নির্দেশ অনুসারে ধাপের পর ধাপ আমি নেমে এলাম বাহ্য ক্রিয়া-কর্মে ও বাহ্য চেতনাবলীর দিকে, ফিরে এলাম সেই জগতের মধ্যে যাকে ত্যাগ করেছিলাম তোমাকে লাভ করবার জন্যে। আর এখন যে নেমে গিয়েছি সোপানের একেবারে নিম্নতলে, সবই এমন নির্জীব, নিঃসাড়, অতি-সাধারণ আমার মধ্যে, আমার চারদিকে যে আর আমি বুঝতে পারি না...
তুমি কি চাও আমার কাছ থেকে? এই মন্থর সুদীর্ঘ প্রস্তুতি, এর উদ্দেশ্য কি যদি তার লক্ষ্য হয়ে থাকে এমন পরিণামে পৌঁছান যা বেশির ভাগ মানুষই লাভ করে থাকে কোন রকম নিয়মপালনের ভিতর দিয়ে না গিয়েই?
কেমন করে এমন জিনিস ঘটে যে আমি যা সব দেখেছি, তা দেখবার পর, যে সব অভিজ্ঞতা পেয়েছি তা পাবার পর, তোমার চেতনার, তোমার সঙ্গে যোগাযোগের পুণ্যতম গর্ভগৃহে উত্তীর্ণ হবার পরেও, আমাকে তুমি তৈরী করে ধরলে এমন এক যন্ত্ররূপে যা সম্পূর্ণ অতি-সাধারণ এবং রাখলে অতি-সাধারণ অবস্থার মধ্যে? ভগবান, সত্যসত্যই তোমার উদ্দেশ্য অনবধারণীয়, আমার বুদ্ধির অগম্য।…
আরো, আমার হৃদয়ের মধ্যে যখন তুমি তোমার পূর্ণানন্দের শুদ্ধতম হীরকখানি স্থাপন করেছ, তা হলে বাহির থেকে আগত ছায়া সব কেন তার উপর প্রতিফলিত হতে দাও, আর এইভাবে যে শান্তিরত্ন তুমি আমায় দান করেছ, চাও কি তা অখ্যাত ও নিরর্থক হয়ে থাক? সত্যই এসব একান্ত রহস্যময়, আমার বুদ্ধিকে বিপর্যস্ত করে দেয় ৷
কেন তবে অন্তরে এমন বিপুল নীরবতা দিয়েছ আর বাহিরে এত সচল করে তুলেছ জিহ্বাকে, চিন্তাকে এত সব অকিঞ্চিৎকর জিনিস নিয়ে ব্যাপৃত রেখেছ? কেন? ...আমি প্রশ্ন করে যেতে পারি চিরকাল, হয়তো চিরকাল বৃথাই।
আমার উচিত তোমার আদেশ অবনতমস্তকে গ্রহণ করা, আমার বর্তমান অবস্থাকে বিনাবাক্যে স্বীকার করা ।
আমি এখন শুধু সাক্ষীমাত্র, তাকিয়ে দেখছি সৃষ্ট-অজগর তার পাক ক্রমেই খুলে খুলে চলেছে অফুরন্ত।
(কয়েক দিন পরে)
ভগবান, কতবার তোমার আদেশের সম্মুখে দুর্বল হয়ে পড়ে, তোমাকে প্রার্থনা করেছি, “পার্থিব-চেতনার এই অগ্নি পরীক্ষা থেকে আমাকে মুক্তি দাও, তোমার সমুচ্চতম একত্বের মধ্যে আমাকে ডুবে যেতে দাও।” কিন্তু আমার প্রার্থনা কাপুরুষতা, আমি জানি, তাই তা নিষ্ফল থেকে যায়।
১৫ অক্টোবর ১৯১৭
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
নিরাশায় পড়ে, ভগবান, তোমাকে আমি ডেকেছি, তুমি শুনেছ আমার ডাক।
আমার জীবনের অবস্থা নিয়ে অনুযোগ করা ভুল আমার হয়েছে; আমি নিজে যা, তারই অনুরূপ নয় কি সে-অবস্থা?
তোমার ঐশ্বর্যের দুয়ার অবধি তুমি আমায় নিয়ে এলে, তোমার সুছন্দের আনন্দভোগ আমায় দিলে, তাই আমার মনে হল লক্ষ্যে যেন পৌঁছে গিয়েছি। কিন্তু সত্য কথা হল এই যে, তুমি তোমার যন্ত্রটিকে তোমার জ্যোতির পূর্ণ আলোকে দেখে নিলে তাকে আবার ডুবিয়ে রাখলে জগতের অগ্নি-চুল্লির মধ্যে যাতে আবার সে গলে যায়, পরিশুদ্ধ হয়ে আসে।
এই সব মুহূর্তে যখন আস্পৃহা যেমন একান্ত তীব্র তেমনি বেদনাক্লিষ্ট, আমি অনুভব করি, দেখতে পাই – আমাকে যেন তুমি টেনে নিয়ে চলেছ বিভ্রান্তকারী দারুণ বেগে তোমার রূপান্তরের পথে, সমস্ত আধার স্পন্দিত হয়ে ওঠে অনন্তের সঙ্গে সচেতন সংযোগে ।
এই রকমেই তুমি আমাকে দিয়ে থাক ধৃতি আর শক্তি যাতে আমি নূতন পরীক্ষাটি পার হয়ে যেতে পারি।
২৫ নভেম্বর ১৯১৭
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
ভগবান, নিদারুণ এক দুঃখের মুহূর্তে, আমার একান্ত আন্তরিক শ্রদ্ধা নিয়ে তোমায় আমি বলেছি, “তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক”, তাইতো তুমি এলে তোমার মহিমায় মণ্ডিত হয়ে। তোমার পদতলে আমি প্ৰণিপাত করলাম, তোমার বুকের মধ্যে পেলাম আশ্রয়। আমার সত্তা তুমি ভরে দিলে তোমার দিব্যবিভায়, ভাসিয়ে দিলে তোমার পরম-আনন্দে। তোমার সৌমিত্রকে দৃঢ় করলে, তোমার নিরবচ্ছিন্ন সান্নিধ্যকে নিঃসন্দেহ করলে। বন্ধু তুমি, কখনও ব্যর্থ কর না আমাদের, শক্তি তুমি, সহায় তুমি, দিশারী তুমি। আলো তুমি, সকল অন্ধকার দূর কর; বিজয়ী তুমি, জয় সুনিশ্চিত তোমার কল্যাণে। যখন থেকে তুমি রয়েছ এখানে, তখন থেকেই সব পরিষ্কার হয়ে উঠেছে; আমার দৃঢ়প্রতিষ্ঠ হৃদয়ে অগ্নিদেব প্রজ্বলিত, তার প্রভা ছড়িয়ে পড়ছে, সমস্ত আবহাওয়া শুদ্ধ করে, উদ্ভাসিত করে ধরেছে।...
তোমার প্রতি আমার ভালবাসা এতদিন ছিল নিরুদ্ধ, এখন ফিরে আবার ছুটে বের হয়েছে, অদম্য বেগে, দশগুণ শক্তি নিয়ে সর্বজয়ী হয়ে, তার পরীক্ষার ভিতর দিয়ে। একান্তবাসে সে পেয়েছে বীর্য, সত্তার বাহ্যস্তরে উঠে আসবার সামর্থ্য, সমগ্র চেতনার উপর আপন আধিপত্য স্থাপন করবার জন্যে, তার পরিপ্লাবী স্রোতে সকল জিনিস গ্রাস করবার জন্যে । ...
তুমি আমায় বলেছ, “আমি এলাম ফিরে, আর তোমায় ছেড়ে যাব না । ”
আভূমিপ্রণত হয়ে তোমার প্রতিশ্রুতি আমি শিরোধার্য করি।
বছর: ১৯১৮
১২ জুলাই ১৯১৮
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
অকস্মাৎ, তোমার সম্মুখে আমার সকল আত্মাভিমান খসে পড়ল। আমি বুঝলাম তোমার সাক্ষাতে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে অতিক্রম করবার চেষ্টা কতখানি বৃথা... আমি অশ্রুপাত করলাম, অঝোরে অকুণ্ঠায়, আমার জীবনের মধুরতম অশ্রু সে... সত্যই এই যে অশ্রু তোমার সম্মুখে আমি ঢেলেছি সরম সংযম না মেনে, কি তৃপ্তিকর, কি শান্তিকর, কি মধুর তা! পিতার কোলে সন্তানের মত নয় কি? আর এমন পিতা! কি মহত্ত্ব, কি ঔদার্য, কি বিপুল অবধারণা! আর কি শক্তি, আর সাড়ার কি পরিপূর্ণতা ! সত্যই, এ অশ্রুধারা যেন স্বর্গের শিশিরবিন্দু। এর কারণ কি এই যে আমি অশ্রুপাত করেছি কিন্তু নিজের দুঃখে নয়? আহা! কি মধুর, কি স্বস্তিকর অশ্রু! তোমার সম্মুখে তারা আমার হৃদয় খুলে দিল অকুণ্ঠভাবে অপরূপ একটি মুহূর্তে, অবশিষ্ট যা-কিছু বাধা তোমার ও আমার মধ্যে ছেদ টেনে দিতে পারত তা সব গলে মুছে গেল ৷
কিছুদিন পূর্বে আমি জেনেছি, আমি শুনেছি এই কথা, “তুমি যদি আমার সাক্ষাতে অশ্রুপাত কর, কোন আবরণ না রেখে, কুণ্ঠা না রেখে, তা হলে অনেক-কিছুর পরিবর্তন হবে, এক মহাবিজয় লাভ হবে।” তাই যখন দেখলাম বুকের ভিতর থেকে চোখ অবধি অশ্রুধারা উঠে আসছে, তখন তোমার সম্মুখে এসে বসলাম, অশ্রুধারাকে ছেড়ে দিলাম বয়ে চলতে, অর্ঘ্যের মত, ভক্তিনত চিত্তে। সে অর্ঘ্য হয়ে উঠল কি মধুর, কি আশ্বাসপূর্ণ!
এখন পর্যন্ত – যদিও অশ্রুপাত আর করি না – তোমাকে এত কাছে পাই, এত কাছে যে আমার সমস্ত সত্তা আনন্দে শিহরিত হয়ে ওঠেছে।
শিশুর কাকলিতে বলি তবে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি, শিশুর পুলক নিয়ে বলি তোমায় ডেকে:
“ভগবান, পরমেশ, একমাত্র অন্তরঙ্গ তুমি, তুমি তো আগে থেকেই জান কি তোমাকে বলা হবে, কারণ তুমিই তো বলাও সে কথা।
“ভগবান, পরমেশ, একমাত্র মিত্র তুমি, তুমি আমাদের গ্রহণ কর, আমাদের ভালবাস, আমাদের বুঝে নাও, ঠিক আমরা যেমন তেমনভাবে কারণ তুমিই তো আমাদের এরকমটি করেছ।
“ভগবান, পরমেশ, একমাত্র দিশারী তুমি, আমাদের যে ঊর্ধ্বতম এষণা তুমি তাকে কখন খণ্ডন কর না, কারণ তার মধ্যে রয়েছে তোমারই এষণা তুমি ছাড়া এমন আর কাউকে খোঁজা যে আমাদের কথা শুনবে, বুঝবে, আমাদের ভালবাসবে, পথ দেখিয়ে দেবে, তা হল মূঢ়তা, কারণ তুমিই তো রয়েছ সে-কাজের জন্যে আর তুমি তো কখনও আমাদের ছেড়ে যাও না ।
“পরম আনন্দ, সমুচ্চ আনন্দ কি, তুমি আমায় বুঝিয়েছ, বুঝিয়েছ নির্দোষ নির্ভর, পরিপূর্ণ নির্ভয়, অখণ্ড আত্মদান, নেই সেখানে কুণ্ঠা বা অবগুণ্ঠন, নেই প্রয়াস বা নিগ্রহ ।
“শিশুর মত মহা-উল্লাসে তোমার সম্মুখে আমি হেসেছি, কেঁদেছি যুগপৎ, হে দয়িত আমার । ”..
বছর: ১৯১৯
৩ সেপ্টেম্বর ১৯১৯
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
“ওইওয়াকে” :
এত অনুরাগ এত যত্ন দিয়ে যে ভোজ্য আমি তৈরী করলাম, মানুষ তা চাইল না, তাই ভগবানকে ডাকলাম গ্রহণ করতে।
ভগবান, তুমি তো গ্রহণ করলে আমার নিমন্ত্রণ, আমার পাতা আসনে এসে বসলে আর আমার তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর নৈবেদ্যের পরিবর্তে আমায় দান করলে শেষ মুক্তি! আজ প্রাতেও আমার বুক ভারি হয়ে ছিল বেদনায় চিন্তায়, মাথা আমার অভিভূত হয়ে ছিল দায়িত্বের ভারে – এখন তাদের বোঝা সব নেমে গিয়েছে, লঘু হয়ে পুলকিত হয়ে উঠেছে, বহুদিন থেকে আমার অন্তর যেমন ঠিক তেমনি। আর পূর্বে আমার অন্তরাত্মা যেমন স্মিত হাস্যে চেয়েছিল তোমার দিকে, ঠিক তেমনি চেয়ে রয় দেহ আজ।
এখন হতে তাহলে, হে ভগবান, এ আনন্দ আমার কাছ থেকে আর তো ফিরিয়ে নেবে না? আমি মনে করি, এবার আমার শিক্ষা পূর্ণ হয়েছে, ধাপে ধাপে আমি উঠে গিয়েছি শেষ চূড়ায় যেখানে রয়েছে নবজন্ম। সমস্ত অতীতের যতটুকু এখনো অবশিষ্ট তা হল বিপুল এক প্রেমাবেশ, তা আমায় দিয়েছে শিশুর নির্মল হৃদয় আর দেবতার ভার-হারা মুক্ত চিন্তা ।
বছর: ১৯২০
২২ জুন ১৯২০
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
পণ্ডিচেরী :
কোন ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, করুণা করে তুমি আমায় দিয়েছিলে এমন আনন্দ, হে আমার দয়িত ভগবান; এখন তুমি দিয়েছ আবার পরীক্ষা, যুদ্ধ, কিন্তু একেও আমি হাসিমুখে গ্রহণ করেছি, তোমার মহান্ বার্তাবহরূপে। একদিন ছিল যখন সংঘর্ষকে আমি ভয় করতাম – শান্তির উপর সম্মেলনের উপর আমার যে আন্তরিক অনুরাগ তা ব্যাহত হয় বলে। কিন্তু এখন ভগবান, আমি ওকে সানন্দে বরণ করে নিয়েছি – এ তো তোমার কর্মের এক মূর্তি, তোমার কর্মের যেসব অঙ্গ হয়তো আমরা ভুলে বসতাম তাদের স্পষ্ট করে তুলে ধরবার হল শ্রেষ্ঠ উপায় – সঙ্গে করে এ নিয়ে আসে বিস্তারের, বৈচিত্র্যের, সামর্থ্যের বোধ । একদিকে তোমাকে আমি দেখছি তোমার গৌরবোজ্জ্বল মূর্তিতে তুমি সংঘর্ষকে জাগিয়ে তুলেছ, ঠিক তেমনি তুমিই আবার পরস্পরবিরোধী ঘটনা ও প্রেরণারাজির জটিলতা সব খুলে ধরেছ, পরিশেষে, সর্বজয়ী হয়ে দাঁড়িয়েছ যা-কিছু তোমার আলোক তোমার শক্তি ঢেকে ফেলত তাদের উপর – কারণ সমস্তেরই মধ্যে থেকে উদ্ভূত হবে তোমার আপন সুষ্ঠুতর আত্মসিদ্ধি। ।
বছর: ১৯৩১
২৪ নভেম্বর ১৯৩১
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |
ভগবান, মধুময় প্রভু আমার, তোমার কর্ম সম্পাদনের জন্যেই আমি ডুবে গেলাম জড়স্তরের অতল সব গভীরে; আমি হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম গিয়ে নিশ্চেতনার আর মিথ্যার বিভীষিকা – বিস্মৃতির রাজ্য, কেবল অন্ধকার! কিন্তু আমার মমতলে তবু ছিল স্মৃতি, সেই মর্মতল থেকেই উঠল এই আকৃতি, পৌঁছিল গিয়ে তোমার কাছে অবধি:
“ভগবান! ভগবান! তোমার শত্রুরা যেন চারদিকে জয়ী হয়ে চলেছে । মিথ্যা হয়ে উঠেছে জগতের সম্রাট। তোমার বিহনে জীবন তো মরণ, চিরন্তন নরক। সেখানে আশার স্থানে এসে বসেছে সংশয়, প্রণতির পরিবর্তে এসেছে বিদ্রোহ। বিশ্বাস গিয়েছে শুষ্ক হয়ে, কৃতজ্ঞতা জন্মগ্রহণও করেনি। অন্ধ রিপু সব, হিংস্র আবেগ, পাপ দুর্বলতা তোমার প্রেমের মধুর বিধানকে ঢেকে ফেলেছে, নিষ্পিষ্ট করেছে। ভগবান, তোমার সব – শত্রুকে মিথ্যাকে, কুৎসিতকে, দুঃখকষ্টকে কি জয়ী হতে দেবে? ভগবান, দাও তো আদেশ তোমার বিজয়ের – বিজয় তবে হবেই। আমি জানি আমরা অযোগ্য, জানি জগৎ এখনো প্রস্তুত নয়। কিন্তু তোমায় আমি ডাকি উচ্চকণ্ঠে, তোমার করুণায় পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে – আমি জানি তোমার করুণা আমাদের উদ্ধার করবে।”
আমার প্রার্থনা তাই ঊর্ধ্বে উঠে চলল তোমার দিকে – অতল গহ্বর থেকে আমি তোমায় দেখতে পেলাম; দিব্যবিভায় সমুজ্জ্বল তুমি এসে বললে “সাহস হারিও না, শক্ত হয়ে নির্ভর করে থাক, আমি আসছি।”
বছর: ১৯৩৭
২৩ অক্টোবর ১৯৩৭
অডিও বর্তমানে | অনুপলব্ধ |